০২:৪৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৫

ভারতের উন্নয়নের দুই উদীয়মান রাজ্য

ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে যখন আলোচনা হয়, তখন দুটি রাজ্যের নাম বারবার উঠে আসে—গুজরাট ও তামিলনাডু। এই রাজ্যগুলোর অর্থনীতির গতি, শিল্পায়ন, রপ্তানি ও কর্মসংস্থানে এগুলো শীর্ষস্থানে রয়েছে। তবে এই দুই রাজ্যের উন্নয়নের ধরন একেবারেই আলাদা, আর সেখানেই রয়েছে ভারতের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।


ভারতের লক্ষ্য: দ্রুত ও টেকসই প্রবৃদ্ধি

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০৪৭ সালের মধ্যে দেশকে “উন্নত দেশ” বানানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন। অর্থনীতিবিদদের মতে, এই লক্ষ্য পূরণ করতে হলে ভারতের বার্ষিক বৃদ্ধির হার অন্তত ৮% হতে হবে। গত ২৫ বছরে গড় বৃদ্ধি ছিল প্রায় ৬%।

এমন অনেক রাজ্য আছে যারা এই গতি ধরে রাখতে পারে না—তবে গুজরাট ও তামিলনাডু ব্যতিক্রম।


গুজরাট: শিল্পনির্ভর দ্রুত প্রবৃদ্ধির মডেল

গুজরাটের বৈশিষ্ট্য
ভারতের জনসংখ্যার ৫% বাস করে এখানে, কিন্তু দেশের জিডিপির ৮% উৎপাদিত হয় এই রাজ্যে। রপ্তানির এক-চতুর্থাংশেরও বেশি আসে গুজরাট থেকে। গত এক দশকে বার্ষিক বৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ৮%। মাথাপিছু আয় জাতীয় গড়ের চেয়ে ৬০% বেশি।

গুজরাট ঐতিহ্যগতভাবে টেক্সটাইল, হীরা পালিশ ও বন্দরভিত্তিক ব্যবসার কেন্দ্র। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তারা বড় বড় মূলধননির্ভর শিল্প যেমন ফার্মাসিউটিক্যাল ও পেট্রোকেমিক্যাল প্রকল্প আকর্ষণ করেছে। এখন রাজ্য চিপ নির্মাণ ও আর্থিক পরিষেবায়ও নজর দিচ্ছে।

ইনফ্রাস্ট্রাকচারে ব্যাপক বিনিয়োগ
গুজরাট বিগত দুই দশকে বিদ্যুৎ উৎপাদন পাঁচ গুণ বাড়িয়েছে এবং সড়ক নেটওয়ার্ককে অত্যন্ত আধুনিক করেছে। এই কারণে বিনিয়োগকারীরা এখানে আসতে আগ্রহী।

কিন্তু সমস্যা কোথায়?
গুজরাট ধনী হলেও এর সাধারণ মানুষের একটি বড় অংশ সেই উন্নয়নের সুফল পাচ্ছে না।
রাজ্যের প্রায় ১২% মানুষ “বহুমাত্রিক দারিদ্র্য”-তে ভুগছে—যা তামিলনাডুর তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি।
উচ্চবিদ্যালয় পর্যন্ত পড়াশোনা করা কিশোরের হার ৫০%-এরও নিচে, যা জাতীয় গড়ের কম।

স্থানীয় অর্থনীতিবিদদের মতে, গুজরাটে বড় কারখানাগুলো মুনাফা করলেও পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান তৈরি করে না। মানবসম্পদ উন্নয়ন তাই বড় ঘাটতি।


তামিলনাডু: মানবসম্পদ ও শিল্প—দুই ক্ষেত্রেই সুষম সাফল্য

তামিলনাডুর অর্থনৈতিক অগ্রগতি
গত বছর রাজ্যটি ১১% প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে—ভারতের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর পেছনে প্রধান ভূমিকা ইলেকট্রনিকস উৎপাদনের, বিশেষ করে অ্যাপলের উৎপাদন সম্প্রসারণ।

২০২৪-২৫ সালে তামিলনাডুর ইলেকট্রনিকস রপ্তানি ছিল ১৫ বিলিয়ন ডলার—ভারতের মোট রপ্তানির প্রায় ৪০%।
রাজ্যটি গাড়ি, মোটরবাইক ও লরি তৈরির অন্যতম কেন্দ্র।
প্রযুক্তি পরিষেবা ও ব্যাক-অফিস কাজেও তামিলনাডু এখন বড় ভূমিকা নিচ্ছে।

ইনফ্রাস্ট্রাকচারে তুলনামূলক দুর্বলতা
বিদ্যুৎ ব্যবস্থা গুজরাটের তুলনায় দুর্বল।
বড় মহাসড়ক তৈরিতে গুজরাটের মতো ব্যাপক বিনিয়োগ হয়নি।
গুজরাটের মতো বড় প্রণোদনাও দেয় না।

তবুও কেন তামিলনাডু সফল?
কারণ রাজ্যটি মানুষের উন্নয়নে জোর দিয়েছে।
প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গুজরাটের তুলনায় ৬০% বেশি ডাক্তার।
সরকারি হাসপাতালে শয্যার সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি।
৮০% এর বেশি শিক্ষার্থী পূর্ণ স্কুলজীবন সম্পন্ন করে।
উচ্চশিক্ষায় ভর্তি হার ৫০%—জাতীয় গড়ের দ্বিগুণ।
ভারতে নারীদের মধ্যে যারা উৎপাদন খাতে কাজ করেন, তাদের ৪০% শুধুই তামিলনাডুতে।

সামাজিক সংস্কারের শতবর্ষী ধারা
তামিলনাডু বহু আগেই সামাজিক বৈষম্য কমাতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ শুরু করে। এর ফলেই আজ সবার মাঝে উন্নয়নের সুফল পৌঁছাচ্ছে।


ভারতের জন্য শিক্ষা: কোন মডেল অনুসরণযোগ্য?

গুজরাট ও তামিলনাডু দুটোই উপকূলীয় রাজ্য, ব্যবসাবান্ধব সংস্কৃতি ও বিদেশে বড় প্রবাসী সম্প্রদায় রয়েছে—যা অন্য অনেক রাজ্যের নেই। তাই দুটি মডেলই সবার জন্য সরাসরি প্রযোজ্য নয়।

তবে প্রধান শিক্ষা দুটি:
১. শুধু সড়ক, বন্দর ও বিদ্যুৎ বানালে হবে না—মানুষের দক্ষতা উন্নয়ন জরুরি।
২. সামাজিক বাধা যেমন নারী-পুরুষ বৈষম্য, বর্ণব্যবস্থা ও পরিবেশগত সংকট মোকাবিলা না করলে উন্নয়ন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

তামিলনাডু দেখিয়েছে—যদি স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে সমান গুরুত্ব দেওয়া যায়, তবে উন্নয়নের সুফল সবার জীবনে পৌঁছায়। আর তা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করে।


#ভারত_#অর্থনীতি উন্নয়ন_#মডেল #গুজরাট #তামিলনাডু #সারাক্ষণ_রিপোর্ট

জনপ্রিয় সংবাদ

সেনকাকু ঘিরে চীনা টহল রেকর্ড সময় ধরে, জাপানের উদ্বেগ বাড়ছে

ভারতের উন্নয়নের দুই উদীয়মান রাজ্য

১২:২৫:১৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৫

ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে যখন আলোচনা হয়, তখন দুটি রাজ্যের নাম বারবার উঠে আসে—গুজরাট ও তামিলনাডু। এই রাজ্যগুলোর অর্থনীতির গতি, শিল্পায়ন, রপ্তানি ও কর্মসংস্থানে এগুলো শীর্ষস্থানে রয়েছে। তবে এই দুই রাজ্যের উন্নয়নের ধরন একেবারেই আলাদা, আর সেখানেই রয়েছে ভারতের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।


ভারতের লক্ষ্য: দ্রুত ও টেকসই প্রবৃদ্ধি

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০৪৭ সালের মধ্যে দেশকে “উন্নত দেশ” বানানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন। অর্থনীতিবিদদের মতে, এই লক্ষ্য পূরণ করতে হলে ভারতের বার্ষিক বৃদ্ধির হার অন্তত ৮% হতে হবে। গত ২৫ বছরে গড় বৃদ্ধি ছিল প্রায় ৬%।

এমন অনেক রাজ্য আছে যারা এই গতি ধরে রাখতে পারে না—তবে গুজরাট ও তামিলনাডু ব্যতিক্রম।


গুজরাট: শিল্পনির্ভর দ্রুত প্রবৃদ্ধির মডেল

গুজরাটের বৈশিষ্ট্য
ভারতের জনসংখ্যার ৫% বাস করে এখানে, কিন্তু দেশের জিডিপির ৮% উৎপাদিত হয় এই রাজ্যে। রপ্তানির এক-চতুর্থাংশেরও বেশি আসে গুজরাট থেকে। গত এক দশকে বার্ষিক বৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ৮%। মাথাপিছু আয় জাতীয় গড়ের চেয়ে ৬০% বেশি।

গুজরাট ঐতিহ্যগতভাবে টেক্সটাইল, হীরা পালিশ ও বন্দরভিত্তিক ব্যবসার কেন্দ্র। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তারা বড় বড় মূলধননির্ভর শিল্প যেমন ফার্মাসিউটিক্যাল ও পেট্রোকেমিক্যাল প্রকল্প আকর্ষণ করেছে। এখন রাজ্য চিপ নির্মাণ ও আর্থিক পরিষেবায়ও নজর দিচ্ছে।

ইনফ্রাস্ট্রাকচারে ব্যাপক বিনিয়োগ
গুজরাট বিগত দুই দশকে বিদ্যুৎ উৎপাদন পাঁচ গুণ বাড়িয়েছে এবং সড়ক নেটওয়ার্ককে অত্যন্ত আধুনিক করেছে। এই কারণে বিনিয়োগকারীরা এখানে আসতে আগ্রহী।

কিন্তু সমস্যা কোথায়?
গুজরাট ধনী হলেও এর সাধারণ মানুষের একটি বড় অংশ সেই উন্নয়নের সুফল পাচ্ছে না।
রাজ্যের প্রায় ১২% মানুষ “বহুমাত্রিক দারিদ্র্য”-তে ভুগছে—যা তামিলনাডুর তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি।
উচ্চবিদ্যালয় পর্যন্ত পড়াশোনা করা কিশোরের হার ৫০%-এরও নিচে, যা জাতীয় গড়ের কম।

স্থানীয় অর্থনীতিবিদদের মতে, গুজরাটে বড় কারখানাগুলো মুনাফা করলেও পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান তৈরি করে না। মানবসম্পদ উন্নয়ন তাই বড় ঘাটতি।


তামিলনাডু: মানবসম্পদ ও শিল্প—দুই ক্ষেত্রেই সুষম সাফল্য

তামিলনাডুর অর্থনৈতিক অগ্রগতি
গত বছর রাজ্যটি ১১% প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে—ভারতের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর পেছনে প্রধান ভূমিকা ইলেকট্রনিকস উৎপাদনের, বিশেষ করে অ্যাপলের উৎপাদন সম্প্রসারণ।

২০২৪-২৫ সালে তামিলনাডুর ইলেকট্রনিকস রপ্তানি ছিল ১৫ বিলিয়ন ডলার—ভারতের মোট রপ্তানির প্রায় ৪০%।
রাজ্যটি গাড়ি, মোটরবাইক ও লরি তৈরির অন্যতম কেন্দ্র।
প্রযুক্তি পরিষেবা ও ব্যাক-অফিস কাজেও তামিলনাডু এখন বড় ভূমিকা নিচ্ছে।

ইনফ্রাস্ট্রাকচারে তুলনামূলক দুর্বলতা
বিদ্যুৎ ব্যবস্থা গুজরাটের তুলনায় দুর্বল।
বড় মহাসড়ক তৈরিতে গুজরাটের মতো ব্যাপক বিনিয়োগ হয়নি।
গুজরাটের মতো বড় প্রণোদনাও দেয় না।

তবুও কেন তামিলনাডু সফল?
কারণ রাজ্যটি মানুষের উন্নয়নে জোর দিয়েছে।
প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গুজরাটের তুলনায় ৬০% বেশি ডাক্তার।
সরকারি হাসপাতালে শয্যার সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি।
৮০% এর বেশি শিক্ষার্থী পূর্ণ স্কুলজীবন সম্পন্ন করে।
উচ্চশিক্ষায় ভর্তি হার ৫০%—জাতীয় গড়ের দ্বিগুণ।
ভারতে নারীদের মধ্যে যারা উৎপাদন খাতে কাজ করেন, তাদের ৪০% শুধুই তামিলনাডুতে।

সামাজিক সংস্কারের শতবর্ষী ধারা
তামিলনাডু বহু আগেই সামাজিক বৈষম্য কমাতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ শুরু করে। এর ফলেই আজ সবার মাঝে উন্নয়নের সুফল পৌঁছাচ্ছে।


ভারতের জন্য শিক্ষা: কোন মডেল অনুসরণযোগ্য?

গুজরাট ও তামিলনাডু দুটোই উপকূলীয় রাজ্য, ব্যবসাবান্ধব সংস্কৃতি ও বিদেশে বড় প্রবাসী সম্প্রদায় রয়েছে—যা অন্য অনেক রাজ্যের নেই। তাই দুটি মডেলই সবার জন্য সরাসরি প্রযোজ্য নয়।

তবে প্রধান শিক্ষা দুটি:
১. শুধু সড়ক, বন্দর ও বিদ্যুৎ বানালে হবে না—মানুষের দক্ষতা উন্নয়ন জরুরি।
২. সামাজিক বাধা যেমন নারী-পুরুষ বৈষম্য, বর্ণব্যবস্থা ও পরিবেশগত সংকট মোকাবিলা না করলে উন্নয়ন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

তামিলনাডু দেখিয়েছে—যদি স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে সমান গুরুত্ব দেওয়া যায়, তবে উন্নয়নের সুফল সবার জীবনে পৌঁছায়। আর তা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করে।


#ভারত_#অর্থনীতি উন্নয়ন_#মডেল #গুজরাট #তামিলনাডু #সারাক্ষণ_রিপোর্ট