হুলুর জনপ্রিয় রিয়েলিটি সিরিজ “দ্য সিক্রেট লাইভস অব মরমন ওয়াইভস” শুধু কিছু সোশ্যাল মিডিয়া তারকার ব্যক্তিজীবনের গল্প নয়—এটি আধুনিক আমেরিকার সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বাস্তবতার এক জটিল প্রতিফলন। সিরিজে দেখা যায় মরমন সম্প্রদায়ের নারী ইনফ্লুয়েন্সারদের জীবন, যাদের পরিচিতি “মমটক” নামে। তাদের জীবনযাপন, বিশ্বাস, দ্বন্দ্ব ও নাটক বর্তমান সমাজের বৈপরীত্যকে আরও স্পষ্ট করে তোলে।
মমটক মূলত মরমন টিকটক তারকাদের একটি গোষ্ঠী। নতুন মৌসুমে কারা ফিরে এসেছে বা কে নেতা হয়েছে—এসব প্রকাশ করাও নিষিদ্ধ। চরিত্রগুলোর নামও অদ্ভুত ও বিচিত্র—বনেট, ব্রি, মরোনিকা, চেস্টলি। তারা নিজেদের বিবাহ ও দাম্পত্য সংকট নিয়ে ভাবলেও অধিকাংশ সময় কাটায় রিট্রিট, পার্টি ও অবিরাম নাটকের মাঝে। পরিবারের গুরুত্বের কথা বললেও তারা যেন পরিবার থেকে দূরে থাকার উপায় খুঁজতেই বেশি আগ্রহী।
সিরিজে এক অদ্ভুত বাস্তবতা উঠে আসে—একই নারীর ধর্মপ্রাণ, গর্ভবতী এবং ‘স্লাটি’ পরিচয় একসাথে সহাবস্থান করছে। গালিগালাজ বা ধর্মীয় অবমাননা নিষিদ্ধ হলেও মিথ্যাচার, গোপনে ফোন শোনা বা কৌশলী আচরণে তাদের কোনো দ্বিধা নেই। তারা প্রার্থনা করে খ্যাতি ও অর্থের জন্য, মানবতার জন্য নয়। ধর্মের প্রতি আনুগত্য ও বাস্তব আচরণের দ্বন্দ্বই সিরিজের বড় বৈপরীত্য।
রিয়েলিটি টিভির দুই প্রান্ত—ধনী, উচ্ছৃঙ্খল “রিয়েল হাউজওয়াইভস” এবং বিনয়ী, ঐতিহ্যনিষ্ঠ “প্লাথভিল”—এই দুইয়ের মাঝামাঝি অদ্ভুত এক অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে “মরমন ওয়াইভস।” এখানে নারীরা বিনয়ীও, আবার সাহসী পোশাক পরেন; ধর্মীয়ও, আবার আচরণে বেপরোয়া; ঐতিহ্যবাদীও, আবার টিকটকের কেন্দ্রে থাকা নাটকের নায়িকাও।

সিরিজে মেয়েরা ধার্মিকতার দাবি করলেও তাদের আচরণ তেমন নয়। মন্দিরে যাওয়ার অনুমতি নিয়ে কথা বলতে বলতে তারা একে অপরের ফোনালাপেও কান পাতেন। যৌনতা নিয়ে তাদের খোলামেলা আলোচনায় স্পষ্ট হয়—চাস্টিটির ধারণা তারা প্রয়োজনমতো বদলে নিয়েছে। নারী স্বাধীনতার নামে ক্ষমতাবোধও এখানে সৌন্দর্য, শরীরচর্চা ও আকর্ষণীয় পোশাকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। শিক্ষা, কর্মজীবন বা ব্যক্তিগত বিকাশ—এসব ক্ষমতাবোধের বাইরে রাখা হয়েছে।
মমটকের সংস্কৃতি Fox News-এর নারী মুখপাত্র, ট্রাম্প যুগের নারী আইকন এবং কনজারভেটিভ নারীসত্তার ধারাকে স্মরণ করিয়ে দেয়, যেখানে মূল বার্তা—সবসময় সুন্দর দেখা, হাসিখুশি থাকা এবং কর্তৃপক্ষের নির্দেশ পালন করা। সিরিজে দেখা যায়—অনেক নারী ক্ষমতার অবস্থানে থেকেও নারীর ক্ষমতাহীনতাকে স্বাভাবিক বলে তুলে ধরেন, যেমন প্রথম মৌসুমে এক অভিনয়শিল্পী পরিবারে উপার্জনকারী হওয়া সত্ত্বেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় আচার থেকে পিছনে সরে যান, কারণ পুরোহিতের ভূমিকা শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য।
মরমন ধর্মের নিজস্ব ইতিহাসও এই সিরিজকে বিশেষ অর্থ দেয়। যুক্তরাষ্ট্রে ক্যাফেইন নিষিদ্ধ থাকলেও ২০১২ সালে হঠাৎই অনুমোদন দেয় চার্চ। বহু বছর কাঁধ ঢাকা পোশাক বাধ্যতামূলক থাকলেও এখন স্লিভলেস পোশাক অনুমোদন পাওয়ায় অনেক নারী বিস্মিত ও বিব্রত। দীর্ঘদিনের লজ্জা, কঠোর নিয়ম এবং আচমকা পরিবর্তন—সব মিলিয়ে ধর্মীয় কর্তৃত্বের দ্বৈত মানসিকতা প্রকাশ পায়।
এই মৌসুমের একটি শক্তিশালী দৃশ্যে একমাত্র দ্বিবর্ণ অভিনেত্রী প্রথমবারের মতো এক কৃষ্ণাঙ্গ হেয়ারস্টাইলিস্টের কাছে গেলে জানান—একসময় চার্চ অশ্বেতাঙ্গ সদস্যদের পূর্ণ সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি দিত না এবং তারা কখনোই পুরোহিত হতে পারতো না। চার্চ এই বর্ণবাদী নীতি বাতিল করেছে মাত্র দশ বছর আগে—যা মরমন ধর্মের জটিল অতীতকে সামনে আনে।

মমটক শুধু সিরিজের একটি গোষ্ঠী নয়—এটি আমেরিকার বৃহত্তর সংস্কৃতির প্রতিফলন। সৌন্দর্যবোধ, ধর্মীয়তা, নারীর ভূমিকা, MLM ব্যবসা, মাতৃত্ব, অনলাইন খ্যাতি—সবকিছু মিলিয়ে মমটক এক খাঁটি আমেরিকান সাংস্কৃতিক উৎপাদন। এটি কোথাও থেকে আমদানি করা নয়; বরং এই সমাজের ভিতরেই জন্ম নেওয়া প্রবণতা।
মৌসুমের শেষে বনেট অভিযোগ করে—তারা যেন মমটক কী ছিল তা ভুলে যাচ্ছে। বাস্তবে যদি মমটক শুরু থেকেই গৃহবন্দী নারীদের আয়ের উপায় হয়ে থাকে, তাহলে তার লক্ষ্য আগের মতোই রয়েছে। কিন্তু অনেক অভিনেত্রী এখন নিজেদের উন্নত জীবন চাইছেন—থেরাপি নিচ্ছেন, শান্তি খুঁজছেন—যেখানে মমটকের মূল উপাদানই হলো বিবাদ, নাটক এবং ভাইরাল হওয়ার মতো দৃশ্য তৈরি করা। তাদের স্বামীরা অর্থনৈতিক সুবিধার জন্য সমর্থন করলেও ব্যক্তিজীবন টিভিতে প্রচার হওয়াকে তারা অপমানজনক মনে করেন।
সব মিলিয়ে স্পষ্ট—এই নারীরা ধর্ম, সৌন্দর্য, মাতৃত্ব, খ্যাতি এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার দোলাচলে আটকে গেছে। তাদের সামনে এক ধরনের বার্তা রাখা হয়েছে—তুমি একই সঙ্গে আকর্ষণীয়ও হতে পারো, গর্ভবতীও হতে পারো, ধর্মপ্রাণও হতে পারো। যেন সব কিছুই সম্ভব।
![]()

#মরমনওয়াইভস #মমটক #আমেরিকানসংস্কৃতি #হুলুসিরিজ #সারাক্ষণরিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















