জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচির তাইওয়ান সংক্রান্ত মন্তব্যের পর চীন কেবল কূটনৈতিক প্রতিবাদেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়নি — সে অর্থনীতিকভাবে জাপানের বিরুদ্ধে চাপ চালানোর অবস্থান নিয়েছে। ভ্রমণ সতর্কতা, বিমান টিকিট ফেরত এবং সামুদ্রিক খাবারের আমদানি স্থগিতের মতো পদক্ষেপ দ্রুত অর্থনৈতিক প্রভাব তৈরি করেছে এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে নতুন সংকটে ঠেলে দিয়েছে।
জাপানের নতুন প্রধানমন্ত্রী তাইওয়ান নিয়ে মন্তব্য করার পর চীন কূটনৈতিক প্রতিবাদ জানালে সাথে সাথে অর্থনৈতিক চাপের বিভিন্ন উপায়ও প্রয়োগ করতে শুরু করে। যা প্রথমে দ্বিপাক্ষিক বিরোধ মনে হলেও তা দ্রুত বড় আকারের সংকটে পরিণত হওয়ার লক্ষণ দেখিয়েছে। নিচে ঘটনা সহজ ভাষায়, সুস্পষ্ট উপশিরোনামে উপস্থাপন করা হলো।
চীনের সতর্কবার্তা ও অর্থনৈতিক পদক্ষেপ
চীন গত সপ্তাহে নাগরিকদের জাপান ভ্রমণ থেকে বিরত থাকতে সতর্ক করে। ওই ঘোষণার পর চীনের বড় বড় বিমান সংস্থাগুলো জাপানগামী টিকিটে পূর্ণ রিফান্ডের সুযোগ দেয়। পরদিন বেইজিং ঘোষণা করে যে তারা জাপানি সামুদ্রিক খাবারের আমদানি সাময়িকভাবে স্থগিত করবে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, নিরাপত্তা ঝুঁকি, সার্বভৌমত্ব বা কূটনৈতিক চাপে প্রতিক্রিয়া জানাতে চীন বহুবার এ ধরনের অর্থনৈতিক সরঞ্জাম ব্যবহার করেছে—তবে এতে আন্তর্জাতিক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে।

বিরোধের সূচনা: জাপানের প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য
বিরোধ শুরু হয় যখন জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচি বলেন যে যদি তাইওয়ান প্রণালীতে সংঘাত ঘটে তবে জাপান নিজের সামরিক ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারে—এটি কোনো জাপানি প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি হিসেবে দেখা হয়েছে এবং দীর্ঘদিনের কৌশলগত অস্পষ্টতা থেকে সরে আসার ইঙ্গিত রটে। তিনি পরে বলেন এটি কেবল “কাল্পনিক মন্তব্য”, কিন্তু বক্তব্য ফিরিয়ে নিতে অস্বীকৃতি জানান। চীন মন্তব্যটিকে “চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে গুরুতর হস্তক্ষেপ” ও “এক-চীন নীতি লঙ্ঘন” হিসেবে উল্লেখ করে এবং জাপানকে উসকানি বন্ধ করতে সতর্ক করে।
ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ও ব্যাপক টিকিট বাতিল
চীন নাগরিকদের নিরাপত্তা উদ্বেগ দেখিয়ে জাপান ভ্রমণ এড়াতে বলেছে এবং “নিকট ভবিষ্যতে” না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। চীন থেকেই জাপানে সবচেয়ে বেশি বিদেশি পর্যটক আসে, তাই এ নির্দেশের প্রভাব দ্রুত প্রতীয়মান হয়। এয়ার চায়না, চায়না সাউদার্ন ও চায়না ইস্টার্নসহ বড় বিমান সংস্থাগুলো সম্পূর্ণ রিফান্ড দেয়—প্রায় পাঁচ লাখ টিকিট বাতিল হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, তাকাইচির মন্তব্য “চীন-জাপান সম্পর্কের রাজনৈতিক ভিত্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে” এবং জাপানের উচিত অনুশোচনা করে অবস্থান পরিবর্তন করা।
চীনের পুরনো কৌশল: অর্থনীতিকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার
বিশেষজ্ঞ ডিলান লো জানান, ফিলিপাইন ও দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষেত্রেও সম্পর্ক খারাপ হলে চীন একই ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০১৪ সালে ফিলিপাইনে নিরাপত্তা পরিস্থিতি খারাপ হওয়া দাবি করে চীন ভ্রমণ সতর্কতা জারি করলে পর্যটক কমে গিয়েছিল। ২০১৭ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন THAAD ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপনের প্রতিবাদে চীনা ট্যুর এজেন্সিগুলোর উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং কে-ড্রামা ও বিনোদন রপ্তানিতেও অঘোষিত বাধা সৃষ্টি হয়। লো বলেন, ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দ্রুত কার্যকর হয়—যেসব দেশের অর্থনীতি পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল, তারা বড় চাপে পড়ে; তবু এতে দেশগুলো চীন-নির্ভরতা কমিয়ে বিকল্প উৎস খোঁজার কথাও ভাবতে পারে।
সমালোচনা: এ কৌশল কি চীনের ক্ষতি করবে?
হপকিনস-নানজিং সেন্টারের ডেভিড অ্যারেস মন্তব্য করেন, চীন অর্থনীতি ব্যবহার করে রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করছে—এটি নতুন কিছু নয়; কিন্তু এতে চীনের বিরুদ্ধে আঞ্চলিক সন্দেহ বাড়তে পারে। তিনি বলেন, এ ধরনের পদক্ষেপকে চীনের ‘উলফ ওয়ারিয়র’ কূটনীতির অংশ মনে করা হবে—যেখানে সামরিক হুমকি, অর্থনৈতিক চাপ, রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও প্রচারণা একসাথে ব্যবহৃত হয়। এর ফলে অনেক দেশ চীনকে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি ঝুঁকি হিসেবে দেখতে পারে। ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেং চেং মনে করে, এই কৌশল চীনের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে এবং প্রতিবেশী দেশগুলোকে দূরে ঠেলে দিতে পারে; তার মতে, এটি “অকার্যকর ও প্রতিকূল” হতে পারে।

চীনের অভ্যন্তরীণ সমর্থন তৈরির প্রচেষ্টা
অ্যারেসের মতে, অর্থনৈতিক চাপের মাধ্যমে চীন অভ্যন্তরীণ জনগণকে দলসমর্থনে একত্রিত করতে চাইতে পারে। এদিকে গত সপ্তাহে চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমগুলো তাকাইচির মন্তব্যকে আক্রমণ করে এটিকে “সাম্রাজ্যবাদী সামরিক অতীত জাগানোর প্রচেষ্টা” বলে উল্লেখ করেছে। পিপলস ডেইলি মন্তব্য করেছে, এ বক্তব্য “এশিয়ান দেশগুলোর জন্য সতর্কতার সংকেত” এবং জাপান “সামরিকতাবাদের বিপজ্জনক পথে” ফিরে যেতে পারে।
চীনা পর্যটকদের আগ্রহ কমার প্রেক্ষাপট
রেনমিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াং ইওয়েই বলেন, জাপান ভ্রমণ এড়াতে বলা একটি নিয়মিত সতর্কতার অংশ হতে পারে। তার মতে, নিরাপত্তা ঝুঁকি না থাকলেও চীনা পর্যটকদের মধ্যে জাপানে যাওয়ার আগ্রহ পূর্বের তুলনায় কম দেখা যাচ্ছে।
সারসংক্ষেপ
চীন জাপানের বিরুদ্ধে ভ্রমণ সতর্কতা ও বাণিজ্যিক চাপ প্রয়োগ করে রাজনৈতিক অবস্থান জানানোর চেষ্টা করছে। অতীতে এসব পদক্ষেপ আংশিকভাবে কার্যকর হলেও বর্তমানে এই কৌশল চীনের নিজের প্রতিদ্বন্দ্বিতার শিকার হতে পারে—বিশেষ করে আঞ্চলিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির দিক থেকে। ফলত জাপান-চীন সম্পর্কের ভবিষ্যৎ ও উত্তর-পূর্ব এশিয়ার স্থিতিশীলতা নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়ছে।
#tags: চীন-জাপান, কূটনীতি, অর্থনৈতিক-চাপ, তাইওয়ান, আন্তর্জাতিক-সম্পর্ক
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















