গ্যাজেট নাকি কর্মক্ষেত্রের নতুন শৃঙ্খল
চীনে তৈরি ইকফি নামের একটি রিস্টব্যান্ড কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়া ও ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে ভাইরাল হয়ে গেছে। হাতের কব্জিতে পরা এই ব্যান্ড নাকি স্নায়ুতে হালকা ইলেকট্রিক পালস পাঠিয়ে মানুষকে সজাগ রাখে। প্রচারণায় এটিকে বলা হচ্ছে পড়াশোনা ও দীর্ঘ কর্মঘন্টায় মনোযোগ ধরে রাখার “বিজ্ঞানসম্মত” সমাধান, আর কোম্পানি নিজেদের একটি অত্যাধুনিক স্নায়ু–উদ্দীপক হিসেবে উপস্থাপন করছে। জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্মে পণ্যটি দ্রুত স্টক আউট হয়ে গেছে, বিদেশেও পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু একই সঙ্গে চীনা সোশ্যাল মিডিয়াজুড়ে এটিকে নিয়ে তীব্র ব্যঙ্গ–বিদ্রূপ শুরু হয়েছে।
অনেকে এই ডিভাইসকে মানুষের জন্য তৈরি কুকুরের ইলেকট্রিক কলার বা বহনযোগ্য বৈদ্যুতিক চেয়ার বলে কটাক্ষ করছেন। অনলাইনে ব্যঙ্গাত্মক পোস্টে বলা হচ্ছে, কাজের চাপ ও বার্নআউট কমানোর বদলে মালিকপক্ষ এখন কর্মীদের শরীরেই শক পাঠিয়ে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে চায়। চীনের বহুল সমালোচিত “৯৯৬” সংস্কৃতি—সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সপ্তাহে ছয়দিন কাজ—নিয়ে জমে থাকা ক্ষোভ এ যন্ত্রটিকে দ্রুত শ্রমিক–অধিকার বিতর্কের কেন্দ্রে এনে দিয়েছে। এক স্ট্যান্ড–আপ কমেডিয়ান মঞ্চে মজা করে বলেছেন, ক্লান্ত হলে বিশ্রাম নয়, নিজের গায়ে বিদ্যুৎ দেব—এটাই নাকি অগ্রগতি।

অপরীক্ষিত বিজ্ঞান ও অতিরঞ্জিত দাবি
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই গ্যাজেটের পেছনের বৈজ্ঞানিক প্রমাণ খুবই দুর্বল। কোম্পানি দাবি করছে, কব্জির স্নায়ু উদ্দীপনার মাধ্যমে সিগনাল উপরে উঠে ভেগাস নার্ভে পৌঁছায়, যা হার্টরেট, স্ট্রেস আর মনোযোগ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। ওয়েবসাইটে দেওয়া গবেষণা প্রবন্ধকে তারা কার্যকারিতার প্রমাণ হিসেবে দেখালেও, গবেষকদের মতে এসব স্টাডির বেশির ভাগই ভিন্ন ধরনের ডিভাইস বা তাত্ত্বিক মডেল নিয়ে, সরাসরি ইকফি পরীক্ষার ফল নয়। এক প্রকৌশলী বলছেন, কোনো ডিভাইস সত্যিই কাজে দেয় কি না বোঝার জন্য কঠোর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল দরকার, কিন্তু এখানে সেই প্রমাণই অনুপস্থিত।
কোম্পানি যে পেটেন্টের কথা বলছে, সেটিও আসলে শুধু ডিজাইন পেটেন্ট—ডিভাইসের ভেতরের প্রযুক্তি নয়, বাহ্যিক নকশা সুরক্ষার দলিল। অস্ত্রোপচারের পর বমি কমাতে একই ধাঁচের একটি ব্যান্ডের পরীক্ষায় কিছু সুফল পাওয়া গেলেও অনলাইন প্রচারণায় ফলাফলকে অতিরঞ্জিত করে দেখানো হয়েছে। আরও একটি ইউরোপীয় ক্লিনিক্যাল স্টাডির কথাও বলা হলেও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের মূল কাজ নারীর সৌন্দর্যবিষয়ক সার্জারি, স্নায়ুবিজ্ঞান নয়—যা সমালোচকদের সন্দেহ আরও বাড়িয়েছে।

ওয়েলনেস মার্কেট, নিয়ন্ত্রণ ও ভবিষ্যতের প্রশ্ন
ইকফি–কে ঘিরে বিতর্ক আসলে বড় একটি প্রবণতার অংশ, যেখানে ডিভাইসগুলোকে চিকিৎসা সরঞ্জাম নয়, জীবনধারার পণ্য হিসেবে বাজারে ছাড়লে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কড়াকড়ি অনেকটাই এড়ানো যায়। ফলে ভোক্তাদের সামনে এমন এক ধূসর অঞ্চল তৈরি হয়েছে, যেখানে “বৈজ্ঞানিক” ভাষা ও পরীক্ষাহীন দাবির ভিড়ে সত্য–মিথ্যা আলাদা করা কঠিন। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, কম পাওয়ারের হলেও শরীরে বিদ্যুৎ পাঠানো গ্যাজেট ব্যবহার করলে মানুষ যদি বিশ্রাম, ছুটি বা চিকিৎসার বদলে কেবল গ্যাজেটের ওপর নির্ভর করে, তা দীর্ঘমেয়াদে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি ডেকে আনতে পারে।
এদিকে বিশ্বজুড়েই নিউরো–ওয়েলনেস গ্যাজেটের বাজার দ্রুত বিস্তৃত হচ্ছে—ঘুম ভালো করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া ভাইব্রেটিং ব্যান্ড থেকে শুরু করে মনোযোগ বাড়ানোর হেডসেট পর্যন্ত। সত্যিকারের প্রশ্ন হলো, এগুলো কতটা বাস্তব উপকার দিচ্ছে, আর কতটা কেবল মানুষকে অস্বাভাবিক কাজের চাপে মানিয়ে নিতে শিখাচ্ছে। ইকফিকে ঘিরে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, সেটি হয়তো ভবিষ্যতে প্রযুক্তি, স্নায়ুবিজ্ঞান ও শ্রমিক–অধিকার–সংক্রান্ত আরও অনেক সংঘাতের পূর্বাভাস দিয়ে যাচ্ছে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















