প্রিন্সের সফর ও উৎসাহব্যঞ্জক প্রতিশ্রুতির আড়ালের বাস্তবতা
সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সাম্প্রতিক ওয়াশিংটন সফর আবারও পরিচিত এক চিত্র তুলে ধরেছে—তেলসমৃদ্ধ সৌদি আরবের শীর্ষ নেতৃত্ব যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও মার্কিন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে সম্পর্ক শক্ত করছে। এই সম্পদের প্রদর্শন সৌদি আরবের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ও দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অবস্থানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য অর্থনৈতিক রূপান্তরের যে প্রতিশ্রুতি সৌদি সরকার দিয়ে চলেছে, তার কেন্দ্রে আছে বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ পরিকল্পনা। তবে আলোচনার ভেতরে ভিন্ন এক বাস্তবতা ঘুরপাক খাচ্ছে—সৌদির পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড বা পিআইএফ নতুন বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় নগদ অর্থের টানাপোড়েনে পড়ছে। ক্রাউন প্রিন্স ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রে ১ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিলেও তহবিলের প্রকৃত সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
পিআইএফ-এর সংকট ও অচল প্রকল্পগুলোর বোঝা
পিআইএফ-এর বিপুল অর্থ বর্তমানে আটকে আছে কয়েকটি উচ্চাভিলাষী প্রকল্পে, যেগুলোর বাস্তব অগ্রগতি খুবই কম। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত নিওম, যা একসময় ভবিষ্যতের স্বপ্ননগরী হিসেবে উন্মোচিত হয়েছিল রোবট কর্মী, বিলাসবহুল স্কি রিসোর্ট এবং সাদা মার্বেলের সমুদ্রতটসহ। কিন্তু প্রকল্পটি এখন বিলম্ব, খরচ বৃদ্ধি এবং ব্যবস্থাপনাগত সমস্যায় জর্জরিত। পাশাপাশি আরও কয়েকটি প্রকল্প রয়েছে যেগুলো প্রায় অচল—একটি মাত্র দোকানবিশিষ্ট কফি চেইন, একটি মাত্র জাহাজ নিয়ে পরিচালিত ক্রুজ লাইন, এবং তিন বছরেও একটি গাড়ি তৈরি করতে না পারা বৈদ্যুতিক গাড়ি কোম্পানি।
এদিকে সৌদি সরকারের তেল আয়ে সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে আন্তর্জাতিক উৎপাদনচুক্তি ও ক্রুড তেলের নিম্নমূল্যের কারণে। সরকারের বাজেট ঘাটতি বাড়ছে এবং ক্রাউন প্রিন্সের উন্নয়ন প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে নতুন ঋণ নেওয়ার প্রয়োজন পড়ছে। যদিও পিআইএফ দাবি করে তাদের সম্পদ প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার, কিন্তু এর বড় অংশই এমন সম্পদে বিনিয়োগ—যেগুলো দ্রুত বিক্রি করা সম্ভব নয় এবং যেগুলোর স্বচ্ছ মূল্যায়নও নেই।

অভ্যন্তরীণ পুনর্গঠন ও নতুন কৌশলের খোঁজ
পিআইএফের অভ্যন্তরে এখন বড় ধরনের পুনর্গঠন চলছে। ক্রাউন প্রিন্সের নির্দেশে ক্ষতিগ্রস্ত প্রকল্পগুলোর নেতৃত্বে পরিবর্তন আনা হয়েছে। নিওম প্রকল্পের প্রধানকেও সরানো হয়েছে। বিভিন্ন বিনিয়োগ প্রকল্পের ভবিষ্যৎ আয়ের হিসাব কমিয়ে আনা হয়েছে, বিশেষ করে লাল সাগরের বিলাসবহুল রিসোর্টগুলোর ক্ষেত্রে যেগুলো প্রায় ফাঁকা পড়ে আছে। একই সঙ্গে তহবিল আরও প্রচলিত খাতে, যেমন পাবলিক মার্কেট, স্টক ও বন্ডে বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা করছে। আগামী পাঁচ বছরে পিআইএফ-এর মোট আকার ২ ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারিত হলেও কতটা আয় থেকে আসবে এবং কতটা সরকারি অর্থায়ন প্রয়োজন হবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়।
নতুন আগ্রহ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও গেমিং খাতে
সাম্প্রতিক সময়ে পিআইএফ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খাতে নতুন বিনিয়োগ শুরু করেছে। এ বছরের সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ ছিল বিশ্বখ্যাত ভিডিও গেম কোম্পানি ইলেকট্রনিক আর্টসে নিয়ন্ত্রণমূলক শেয়ার কেনার বিড। এটি দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ হিসেবে উপস্থাপিত হলেও অনেকে মনে করছেন ক্রাউন প্রিন্স নিজে গেমিং-এ আগ্রহী হওয়ায় এই সিদ্ধান্তে তাঁর ব্যক্তিগত পছন্দও ভূমিকা রেখেছে।
পিআইএফ-এর উত্থান ও ক্ষমতার কেন্দ্রে প্রিন্স মোহাম্মদের ভূমিকা
পিআইএফকে পুনর্গঠিত করে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার পেছনে মূল ভূমিকা প্রিন্স মোহাম্মদের। দীর্ঘদিন দেশীয় খাতে বিনিয়োগকারী একটি ক্ষুদ্র তহবিল ছিল পিআইএফ। ২০১৫ সালে এর দায়িত্ব প্রিন্সের হাতে যাওয়ার পর তহবিল নতুনভাবে জন্ম নেয়। সরকারি অর্থ প্রবাহ, বিদেশি ঋণ, এবং ২০১৭ সালের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে আটক ব্যবসায়ী ও রাজপরিবারের সদস্যদের সম্পদ পিআইএফে স্থানান্তরের মাধ্যমে তহবিল দ্রুত সম্প্রসারিত হয়। আন্তর্জাতিক বড় বড় কোম্পানিতে বিনিয়োগ, ক্রীড়া খাতে বিপুল ব্যয় এবং গলফ লিগসহ নানা কর্মসূচির মাধ্যমে পিআইএফ বৈশ্বিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসে।

“ডাভোস ইন দ্য ডেজার্ট”-এ পরিবর্তিত পরিবেশের ইঙ্গিত
ফিউচার ইনভেস্টমেন্ট ইনিশিয়েটিভ বা “ডাভোস ইন দ্য ডেজার্ট” নামে পরিচিত সম্মেলন দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমা বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণের কেন্দ্র ছিল। কিন্তু এ বছর পরিবেশ ছিল ভিন্ন। অনেকেই বলছেন, আগের মতো এখন আর রিয়াদে এলেই বড় অঙ্কের অর্থ পাওয়া যায় না। এমনকি দীর্ঘদিনের কয়েকজন প্রভাবশালী অংশগ্রহণকারীও দেরিতে আসেন বা অনুপস্থিত থাকেন। সম্মেলনে পিআইএফ জানিয়ে দেয়, নতুন অর্থ বরাদ্দের জন্য বিনিয়োগকারীদের সাহায্য করতে হবে তহবিলের পুরোনো প্রকল্পগুলোর ঘাটতি পূরণে। অর্থাৎ বিনিয়োগকারীদের অর্থ আবারও সৌদির সমস্যাগ্রস্ত প্রকল্পগুলোতেই ঢুকতে হবে।
এমনকি সম্মেলন আয়োজনকারী কোম্পানি বিক্রির চেষ্টা করলেও ক্রেতা পাওয়া যায়নি। এখন সেটিকে সৌদি স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত করার প্রস্তুতি চলছে।
সৌদি আরবের অর্থনৈতিক রূপান্তরের বড় স্বপ্ন ও রাজনৈতিক বক্তব্যের আড়ালে পিআইএফ-এর আর্থিক সংকট স্পষ্ট হয়ে উঠছে। উচ্চাভিলাষী প্রকল্প, সীমিত তেল আয়, বাজেট ঘাটতি এবং সমস্যাগ্রস্ত বিনিয়োগের চাপে তহবিলের সামর্থ্য এখন প্রশ্নের মুখে। পুনর্গঠন, নতুন কৌশল এবং বাস্তবভিত্তিক বিনিয়োগের ওপর গুরুত্ব না দিলে সৌদির অর্থনৈতিক শক্তির মূল স্তম্ভটি দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।
# সৌদি_পিআইএফ #সৌদি_অর্থনীতি #মোহাম্মদ_বিন_সালমান #নিওম #মধ্যপ্রাচ্য #আন্তর্জাতিক_বিনিয়োগ
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















