চীনের নৌবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা খাতে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ ও গভীর সমুদ্র প্রযুক্তি গবেষণায় যুক্ত জিয়াংসু ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির প্রধান বিজ্ঞানী গুয়ো ওয়েইকে ভুয়া শিক্ষাগত যোগ্যতা, প্রতারণা এবং রাষ্ট্রীয় গবেষণা তহবিল ব্যবহারে অনিয়মের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ঘটনাটি চীনের সামরিক গবেষণা মহলে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান বিজ্ঞানী গুয়ো ওয়েইকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অভিযোগ করা হয়েছে—তিনি ভুয়া শিক্ষাগত যোগ্যতা দেখিয়েছেন এবং গবেষণা তহবিলের অপব্যবহার করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিশ্চিতকরণ ও পদচ্যুতি
জিয়াংসু ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি জানায়, গুয়ো ওয়েই–এর বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে এবং তার একাডেমিক চুক্তি বাতিল করা হয়েছে।
১৯৫৩ সালে মাও সেতুং–এর উদ্যোগে শক্তিশালী নৌবাহিনী গড়ে তোলার লক্ষ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়—যা গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রথম জাহাজ নির্মাণভিত্তিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মধ্যে শানডং বিমানবাহী রণতরীর প্রধান ডিজাইনারও রয়েছেন।
গুয়ো ছিলেন উপাদান প্রকৌশল (materials science and engineering) অনুষদের গবেষক—যে অনুষদ জিয়াওলং সাবমার্সিবল থেকে চন্দ্র অনুসন্ধান প্রকল্প পর্যন্ত বহু বড় প্রযুক্তি উদ্যোগে কাজ করেছে।

টাইটানিয়াম অ্যালয় নিয়ে আলোচিত গবেষণা
চীন ন্যাশনাল রেডিওর রিপোর্ট অনুযায়ী, গুয়োর নেতৃত্বে একটি দল অতি-নিম্ন তাপমাত্রা সহনশীল টাইটানিয়াম অ্যালয় তৈরি করে, যা –২৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ঠান্ডা ও গভীর সমুদ্রের উচ্চ চাপেও ভাঙে না।
এই অ্যালয় মারিয়ানা ও নিউ ব্রিটেন ট্রেঞ্চসহ সাতটি গভীর সমুদ্রযানে ব্যবহৃত হয়েছে।
দলটি আরও গবেষণা করছিল ক্ষয়রোধী উপকরণ, কম খরচে উৎপাদন প্রযুক্তি এবং সামুদ্রিক প্রকৌশল, মহাকাশ ও নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে সম্ভাব্য ব্যবহারের ওপর।
শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ
প্রথমদিকে গুয়োর গবেষণা–প্রোফাইল অত্যন্ত আকর্ষণীয় মনে হলেও পরে একের পর এক তথ্য প্রকাশিত হতে থাকে—যার ফলে জানা যায়, তার বেশিরভাগ শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্ভবত জাল।
বিভিন্ন অনলাইন আলোচনায় বলা হয়, তার প্রকৃত শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্ভবত কেবল হাইস্কুল।
তার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোফাইল পেজও রহস্যজনকভাবে মুছে ফেলা হয়েছে।
গুয়ো দাবি করেছিলেন—
• তিনি ১৯৯৪ সালে শানসি প্রদেশে বিজ্ঞানে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে শিয়ান জিয়াওতং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।
• পরে অস্ট্রেলিয়ার উলংগং বিশ্ববিদ্যালয়ে ন্যানো ব্যাটারি গবেষণা করেন।
• জাপানের কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি শুরু করেন।
• এরপর জার্মানিতে স্যানি গ্রুপের ইউরোপীয় শাখার প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করেন এবং জার্মানির জাতীয় বিজ্ঞান একাডেমি ‘লিওপোলদিনা’–র সদস্য ছিলেন।
কিন্তু এসব দাবির কোনোটিই যাচাইযোগ্য নয়।
তথ্যগুলোর অসঙ্গতি একে একে ফাঁস
• ১৯৯৪ সালে শানসি প্রদেশে সর্বোচ্চ নম্বরপ্রাপ্ত ছাত্র ছিলেন অন্য একজন—যিনি তসিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।
• উলংগং বিশ্ববিদ্যালয়ে যে গবেষণা দলে তিনি ছিলেন বলে দাবি করেছেন—সে দলের নেতৃত্বে থাকা জুডি রেপার সেখানে যোগ দেন ২০০৮ সালে, তার দাবি অনুযায়ী সময়ের বহু বছর পরে।
• লিওপোলদিনার তালিকায় তার নাম নেই।
• তিনি নেচার ম্যাটেরিয়ালস–এ গবেষণা প্রকাশ করেছেন—এই দাবিরও প্রমাণ নেই।
• ২০১৬ সালে শীর্ষ রাষ্ট্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পুরস্কার পাওয়ার দাবি—তাও আরেকজন ‘গুয়ো ওয়েই’–এর নামের সাথে মিলে গেছে।
• Acta Materialia ও Scripta Materialia–এর সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হওয়ার দাবিরও কোনো প্রমাণ নেই।
ব্যবসা পরিচালনার প্রমাণ
শাংহাই–ভিত্তিক ThePaper.cn জানায়—গুয়ো মূলত একজন ব্যবসায়ী, যিনি বহু উপাদান প্রযুক্তি–সংস্থার মালিক ছিলেন।
তার সঙ্গে যুক্ত সাতটি দেশীয় প্রতিষ্ঠানের নথি পাওয়া গেছে—যার মধ্যে তিনটির লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে।

প্রতারণা কীভাবে ধরা পড়লো
সোশ্যাল মিডিয়ায় ধারণা করা হচ্ছে—গুয়ো এই বছর চীনের একাডেমির সদস্যপদে আবেদন করার সময় তার প্রতারণা ধরা পড়ে।
তবে একাডেমি নির্বাচন কমিটি বলেছে—তারা এ বিষয়ে অবগত নয়।
গবেষণা ক্ষেত্রের নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে সমালোচনা
ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চেন ইরান সামাজিক মাধ্যমে প্রশ্ন তুলেছেন—
“একজন হাইস্কুল পাস ব্যক্তি কীভাবে দুই বছর ধরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও ধোঁকা দিতে পারলো—এটা সত্যিই অবিশ্বাস্য।”
ঘটনাটি চীনের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগ পদ্ধতি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে—বিশেষত এমন সময়ে যখন বিদেশে প্রশিক্ষিত বিশেষজ্ঞদের আকৃষ্ট করা চীনের অন্যতম অগ্রাধিকার।
অনেকে মন্তব্য করেছেন—
“নিয়োগের সময় যদি সঠিকভাবে সহকর্মীদের মূল্যায়ন (peer review) হতো—এই ঘটনা ঘটতো না।”
জিয়াংসু ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি মন্তব্যের জন্য পাওয়া যায়নি।
#
চীন | নৌবাহিনী | বিজ্ঞানী | প্রতারণা | বিশ্ববিদ্যালয় | গবেষণা | গ্রেপ্তার
#চীন #নৌবাহিনী #বিজ্ঞানী #প্রতারণা #বিশ্ববিদ্যালয় #গবেষণা #গ্রেপ্তার
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















