বাংলাদেশ ও উত্তর-পূর্ব ভারত ইতিহাসে বহু বড় ভূমিকম্পের সাক্ষী। তবে ১৮শ শতকের শেষ দিকে ঘটে যাওয়া এক প্রলয়ঙ্কর ভূমিকম্প পুরো অঞ্চলকে চমকে দিয়েছিল। শুধু ঘরবাড়ি-সম্পদই ধ্বংস হয়নি—এই ভূমিকম্পই বদলে দিয়েছিল ব্রহ্মপুত্রের স্বাভাবিক প্রবাহপথ। ভূগোল, নদীপ্রবাহ ও জনজীবনে এমন বিরাট পরিবর্তন ঘটানো ভূমিকম্প এ অঞ্চলে আর কখনো দেখা যায়নি।
১৮৭৮/১৭৮৭ সালের মহাভূমিকম্প: যে দিন বদলে গেল নদীর মানচিত্র
ইতিহাসবিদ ও ভূতাত্ত্বিকদের বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৭৮৭ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্প (অনেকে ১৮শ শতকের শেষভাগের ‘গ্রেট বেঙ্গল আর্থকোয়েক’ নামে উল্লেখ করেন) পূর্ব-বাংলা ও আসামজুড়ে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল। এর মাত্রা আধুনিক স্কেলে ৮ বা তারও বেশি বলে ধারণা করা হয়। তীব্র কম্পনে শুধু ভূমি দুলেছে তা নয়—পৃথিবীর ভূত্বকের ওপর চাপ সরে যাওয়ায় ব্রহ্মপুত্রের দিক পরিবর্তনের মতো বিরাট ভূ-পরিবর্তন ঘটে।
এই ভূমিকম্পেই ব্রহ্মপুত্র মূল প্রবাহ ত্যাগ করে বদলে ফেলে তার গতিপথ। পুরোনো ধারা ‘ওল্ড ব্রহ্মপুত্র’ ধীরে ধীরে গুরুত্ব হারাতে থাকে, নতুন শাখা হিসেবে জন্ম নেয় বর্তমানের ‘যমুনা’ প্রবাহ। এই পরিবর্তন এতটাই গভীর ছিল যে পুরো নদী ব্যবস্থা নতুনভাবে সংগঠিত হয়ে যায়।
কীভাবে বদলে গেল ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহ?
ভূতাত্ত্বিক গবেষণা বলছে, ভূমিকম্পের পর নদীর পাড়ে বিশাল ভূমিধস, মাটির উত্থান-পতন এবং চ্যানেল ব্লকেজের কারণে নদী তার পুরোনো পথ ছেড়ে নতুন পথে প্রবাহিত হয়। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘অ্যাভালশন’—অর্থাৎ নদীর স্বাভাবিক গতিপথ হঠাৎ বদলে যাওয়া।
ভূমিকম্পের পর প্রধান পরিবর্তনগুলো ছিল—
- পুরোনো ব্রহ্মপুত্র প্রবাহ সংকুচিত হয়ে যায়।
- নদীর মোহনা ও তীরবর্তী অঞ্চল দেবে যাওয়ায় নতুন পথ খুঁজে নেয় নদী।
- ফলাফল হিসেবে গঠিত হয় আজকের যমুনা—বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রশস্ত ও শক্তিশালী নদীগুলোর একটি।
এর প্রভাবে তৎকালীন জনপদের কৃষি, বাণিজ্য, যোগাযোগ, বসতি—সবকিছু এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়।
জনজীবনে বিপর্যয়: গ্রাম-শহর ভাসিয়ে নিয়ে যায় নদী
ব্রহ্মপুত্রের পথ পরিবর্তন কেবল ভূতাত্ত্বিক ঘটনা ছিল না; এটি ছিল সামাজিক-অর্থনৈতিক বিপর্যয়।
মানুষের জীবনে যে পরিবর্তনগুলো আসে—
- বহু গ্রাম নদীভাঙনে হারিয়ে যায়।
- নতুন নতুন চর জেগে ওঠে, আবার পুরোনো বসতি বিলীন হয়ে যায়।
- কৃষি জমি অকেজো হয়ে পড়ে বা সম্পূর্ণ বদলে যায়।
- নদীঘাট, নৌপথ এবং আঞ্চলিক বাণিজ্য প্রায় ভেঙে পড়ে।
এ অঞ্চলে নৌপথ ছিল প্রধান যোগাযোগ ব্যবস্থা; পথ পরিবর্তনের ফলে নৌ-বাণিজ্যের কেন্দ্র বদলে যায়, শহর-নগরের উন্নয়নের ধারা অন্য দিকে সরে যায়।
নদী বদলের দীর্ঘমেয়াদি ভূরাজনৈতিক প্রভাব
ব্রহ্মপুত্রের পথ পরিবর্তন শুধু তৎকালীন জনজীবনকেই না, বরং বাংলাদেশের ভূ-গঠন ও অর্থনৈতিক ইতিহাসকেও পাল্টে দেয়।
- যমুনা গঠনের ফলে মধ্যবাংলার নদী ব্যবস্থার ওপর নতুন চাপ তৈরি হয়।
- পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-যমুনার মিলনস্থল জটিল ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
- বন্যা, ভাঙন ও চরাঞ্চলের বিস্তার বাড়ে।
- অঞ্চলভিত্তিক জনবসতির ধারা নতুনভাবে গড়ে ওঠে।
আজকের বাংলাদেশের নদী-ভৌগোলিক কাঠামো এই ভূমিকম্পের প্রত্যক্ষ ফল।
বিজ্ঞানীরা কী বলছেন?
আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে—
- এই ভূমিকম্প ছিল সাবডাকশন জোনে সৃষ্ট, অর্থাৎ টেকটনিক প্লেটের ঠোকাঠুকিতে বিশাল শক্তি মুক্ত হয়েছিল।
- এত বড় শক্তির কারণে নদীর গতিপথ বদলানো সম্ভব হয়েছে।
- স্যাটেলাইট স্টাডি ও সেডিমেন্ট বিশ্লেষণে স্পষ্ট প্রমাণ মেলে যে ব্রহ্মপুত্রের পথ পরিবর্তন আকস্মিক ও গভীর ছিল।
বিশেষজ্ঞদের ভাষায়—
“এটি ইতিহাসের অন্যতম শক্তিশালী ভূমিকম্প, যার প্রভাব আজও বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থায় দৃশ্যমান।”
শেষ কথা: একটি ভূমিকম্প বদলে দিয়েছিল পুরো ভৌগোলিক বাস্তবতা
ব্রহ্মপুত্রের পথ পরিবর্তন কেবল একটি নদীর গল্প নয়—এটি একটি জাতির ভূগোল, অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং মানুষের জীবনযাত্রাকে পাল্টে দেওয়া এক অভূতপূর্ব ঘটনা। ভূমিকম্পের শক্তি কতটা গভীর ও বিস্ময়কর হতে পারে, তার অন্যতম নিদর্শন এই ঐতিহাসিক ধাক্কা।
আজ আমরা যে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদী ব্যবস্থা দেখি, তার মূল নির্মাতা ছিল সেই ১৭৮৭ সালের মহাভূমিকম্প—যে ভূমিকম্প স্থায়ীভাবে বদলে দিয়েছিল এই অঞ্চলের মানচিত্র
সারাক্ষণ রিপোর্ট 




















