জেনেভায় জাতিসংঘের প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে আছে ‘ভাঙা চেয়ার’—যুদ্ধের শিকারদের স্মরণে নির্মিত বিশাল কাঠের স্মারক, যা মানবতার প্রতি নৈতিক আত্মসমর্পণের মূল্য বিশ্বকে মনে করিয়ে দেওয়ার কথা। স্মৃতিস্তম্ভটি তৈরি হয়েছিল সাহস এবং বিবেকের প্রতীক হিসেবে। আজ এটি এমন একটি প্রতিষ্ঠানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, যে প্রতিষ্ঠান প্রায়ই এই দুটির কোনোটিই প্রদর্শন করে না।
ইহুদি ধর্মীয় ক্যালেন্ডারের সবচেয়ে পবিত্র দিনে ম্যানচেস্টারের হিটন পার্ক হিব্রু কংগ্রেগেশন সিনাগগের বাইরে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ ছিল মর্মান্তিক, তবে অপ্রত্যাশিত নয়। বছরের পর বছর প্রচারিত এবং বৈধতা দেওয়া প্রোপাগান্ডা যখন ঘৃণাকে স্বাভাবিক করে তোলে, তখন এমন সহিংসতা একসময় বাস্তবে রূপ নেয়।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর থেকে ইহুদিবিদ্বেষ শুধু বৃদ্ধি পায়নি—এটি আরও তীব্র হয়েছে এবং বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। নানা উদ্যোগ, ঘোষণা, আলোচনা—সবই চলছে, কিন্তু অধিকাংশই প্রতিক্রিয়াশীল এবং ভেতরের দিকে কেন্দ্রীভূত, আর সেই ফাঁকে ঘৃণা আরও নির্মমভাবে বিস্তার লাভ করছে।
এই ঘৃণা শূন্য থেকে সৃষ্টি হয় না। এটি টিকে থাকে এবং শক্তিশালী হয় এমন বিকৃত কথন ও বয়ান থেকে, যা উৎসারিত হয় সেই শহর থেকে, যাকে দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বের মানবিক রাজধানী বলা হয়েছে—জেনেভা।
প্রতি বছর বিশ্বনেতারা নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেন—যা দাবা গ্র্যান্ডমাস্টার গ্যারি কাসপারভ একবার বলেছিলেন “স্বৈরশাসকদের ক্যাটওয়াক”—আর এই মঞ্চ নিয়ন্ত্রণ করে নিরাপত্তা পরিষদ এবং মহাসচিব।
কিন্তু জাতিসংঘের মানবাধিকার কেন্দ্র জেনেভাতেই সেই রিপোর্ট তৈরি হয়, যেখানে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বয়ানকে তদন্ত হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। যে দেশগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য ইরান, চীন, কিউবার মতো রাষ্ট্র—তারা সেখানে প্রস্তাব উত্থাপন করে যা ইসরায়েলের আত্মরক্ষাকে আগ্রাসন বলে চিহ্নিত করে।

জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ এই বিকৃত নৈতিক মানদণ্ডের সবচেয়ে স্পষ্ট উদাহরণ। এর স্থায়ী এজেন্ডা আইটেম ৭ নিশ্চিত করে যে প্রতিটি অধিবেশনে ইসরায়েলকে নিন্দা করা হবে। ফিলিস্তিন বিষয়ে বিশেষ প্রতিবেদক ফ্রান্সেসকা আলবানিজ হামাসের ৭ অক্টোবরের হত্যাযজ্ঞকে “প্রতিরোধ” বলে অভিহিত করেন, ইসরায়েলকে “গণহত্যা”র অভিযোগে অভিযুক্ত করেন এবং দাবি করেন যে “ইহুদি লবি” যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করে।
মানবাধিকার পরিষদের বাইরেও, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জেনেভা সদর দপ্তর থেকে প্রতি বছর একটি করে ইসরায়েলবিরোধী প্রস্তাব পাস হয়, অথচ সিরিয়া ও ইরানের বিরুদ্ধে নীরবতা বজায় থাকে এবং উত্তর কোরিয়াকে এমনকি নির্বাহী বোর্ডেও নির্বাচন করা হয়।
ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড নিয়ে জাতিসংঘ তদন্ত কমিশন—যার নেতৃত্বে আছেন সাবেক জাতিসংঘ মানবাধিকার প্রধান নাভি পিল্লাই—গণহত্যার যে মিথ্যা অভিযোগ আজ বৈশ্বিক আলোচনা শাসন করছে, সেটিকে তারা কার্যত বৈধতা দিয়েছে। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরের রিপোর্টে কমিশন দাবি করে যে ইসরায়েলের পদক্ষেপ “ফিলিস্তিনি জনগণকে ধ্বংস করার অভিপ্রায় প্রদর্শন করে” এবং তা “গণহত্যার সমতুল্য।”
এই অভিযোগের ভিত্তি তৈরি হয়েছে মূলত হামাসের সরবরাহকৃত তথ্য দিয়ে, যেখানে ৭ অক্টোবরের হত্যাযজ্ঞ এবং জিম্মিদের বিষয়টি পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে—কিন্তু জাতিসংঘের নৈতিক সীলমোহর পাওয়ায় অভিযোগটি বিপুল প্রভাব তৈরি করে।
রিপোর্ট প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তা শিরোনামে পরিণত হয়। রয়টার্স লেখে: “গাজায় গণহত্যায় ইসরায়েলি নেতাদের অভিযুক্ত করল জাতিসংঘ তদন্ত।” দ্য গার্ডিয়ান লেখে: “গাজায় গণহত্যা চালিয়েছে ইসরায়েল, বলছে জাতিসংঘ কমিশন।”
জেনেভায় তৈরি রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা মুহূর্তেই বৈশ্বিক নৈতিক রায়ে পরিণত হয়। এরপর তা এনজিওদের তথ্যচক্রে ঢুকে পড়ে—অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল দ্রুত কমিশনের বক্তব্য হুবহু পুনরাবৃত্তি করে বিবৃতি দেয়।
ধ্বংসাত্মক প্রভাবের এই শৃঙ্খল স্পষ্ট: জেনেভায় জন্ম নেওয়া অভিযোগ মিডিয়ায় প্রচার পায়, মানবাধিকারের নামে কথা বলা সংগঠনগুলো তা পবিত্র সত্যে পরিণত করে, তারপর তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বিশ্বব্যাপী রাস্তায় দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে।
এখান থেকে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো—ইহুদিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে ঘৃণার উৎপত্তিস্থলে লড়াই করতে হবে, সেই প্রতিষ্ঠানে যেখানে বৈরিতা নৈতিক জ্ঞান হিসেবে রূপান্তরিত হয়। জাতিসংঘকে দুঃখজনক ইহুদিবিদ্বেষী বলে প্রত্যাখ্যান করা মানে দায়িত্ব এড়ানো, কারণ এই বিকৃত বয়ানই বৈশ্বিক আলোচনাকে আকার দেয় এবং সবচেয়ে বড় কথা—এক প্রজন্মের নৈতিক ভাষাকে দূষিত করে।
জাতিসংঘে অনেক গণতান্ত্রিক দেশ নীরবতাকে ভারসাম্য এবং ঐক্যমত্যকে নীতি ভাবতে অভ্যস্ত। কিন্তু নৈতিক বিকৃতির সামনে নিরপেক্ষতা কূটনীতি নয়—এটি সহযোগিতা।

এই কারণেই আমি জেনেভায় ইউএন ওয়াচে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এটি একমাত্র সংস্থা যা এই বিকৃত ব্যবস্থার মুখোমুখি লড়াই করছে—দ্রুত, দৃঢ় এবং আপসহীনভাবে। মানবাধিকার পরিষদে ফ্রান্সেসকা আলবানিজের ইহুদিবিদ্বেষী অবস্থান, সন্ত্রাসীদের প্রতি সমর্থন এবং তার ম্যান্ডেটের অপব্যবহার—এসব উন্মোচনে ইউএন ওয়াচ অগ্রগামী ভূমিকা রেখেছে, যা পরে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক তার নিন্দা ও নিষেধাজ্ঞায় পরিণত হয়।
ইউএনআরডব্লিউএর বিরুদ্ধে যে তদন্ত ইউএন ওয়াচ প্রকাশ করে, তার ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্র, সুইডেন এবং নেদারল্যান্ডস ৪৬৮ মিলিয়ন ডলার তহবিল স্থগিত করে—কারণ প্রমাণ পাওয়া যায় যে সংস্থাটির কর্মকর্তা ও হামাস-ইসলামিক জিহাদ নেতাদের মধ্যে অশুভ জোট রয়েছে।
ইউএন ওয়াচ ইসরায়েলবিষয়ক তদন্ত কমিশনের পক্ষপাত, সদস্যদের ইহুদিবিদ্বেষী মন্তব্য এবং তাদের অপসারণের জন্য সরকারগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে—এবং শেষ পর্যন্ত তিন কমিশনারই পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
আজকের সংকটময় সময়ে—যখন শব্দ বাস্তবতা তৈরি করে এবং সদিচ্ছা প্রায়ই সতর্কতা ও প্রক্রিয়ার জালে আটকে যায়—ইহুদিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে এইভাবেই লড়াই করতে হবে: সক্রিয়ভাবে, নির্ভয়ে এবং তথ্যপ্রমাণের সর্বোচ্চ নিখুঁততার সঙ্গে।
রাব্বি লর্ড জোনাথন স্যাক্স সতর্ক করেছিলেন—যখন মানুষ কারও অধিকার রক্ষা করে এবং অন্যেরটা অস্বীকার করে, তখন তারা অধিকার নামক ভিত্তিটাই ধ্বংস করে। ম্যানচেস্টারের হামলার দিন আমরা তা স্পষ্টভাবে দেখেছি—মানবাধিকার দাবি করা সমাবেশগুলোতে একটিও কণ্ঠ ইহুদি প্রাণহানির কথা উল্লেখ করেনি। সেই নীরবতা যেকোনো স্লোগানের চেয়ে জোরে কথা বলে।
ভাঙা চেয়ার আজও জাতিসংঘের প্যালেস দে নাসিওর প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে আছে—এর ভাঙা পা যেন সেই নৈতিক ভারসাম্যহীনতার প্রতীক, যার মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি ডুবে আছে। ইহুদিরা আবারও ভয়ে তাদের পরিচয় গোপন রাখতে বাধ্য হচ্ছে। জেনেভায় যা শুরু হয়, তা সেখানেই শেষ হয় না—এটি ছড়ায়, দূষিত করে, এবং হত্যায় রূপ নেয়।
ইহুদিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াই সমঝোতা দিয়ে জেতা যাবে না—জিততে হবে সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াই করে, যারা এই ঘৃণাকে বৈধতা দেয়, এবং সেই স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে যারা এই ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখে। এখানেই সংগ্রাম চালাতে হবে—এবং এখানেই জয়লাভ করতে হবে।
লেখকঃ জেনেভাভিত্তিক ইউএন ওয়াচের চিফ স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড ডিপ্লোমেসি অফিসার।
ড্যানিয়েল ওয়াই. রাডমস্কি 



















