মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবিত্ত শ্রেণি ক্রমাগত আর্থিক চাপে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। প্রায় পাঁচ বছর ধরে টানা পণ্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে তারা ভেবেছিল এখনো পর্যন্ত জীবন কিছুটা স্বস্তিকর হয়ে উঠবে। কিন্তু ২০২০ সালের তুলনায় জীবনযাত্রার ব্যয় এখন প্রায় ২৫ শতাংশ বেশি। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা কমেছে, তবুও কফি, গ্রাউন্ড বিফ, গাড়ি মেরামত—এসব অত্যাবশ্যক জিনিসের দাম এ বছর আরও বেড়েছে।
একজন বিশ্ববিদ্যালয় কমিউনিকেশনস ডিরেক্টর, আয় প্রায় ১ লাখ ৩৫ হাজার ডলার, আটলান্টার বাসিন্দা হলি ফ্রিউ বলেন, “দেড় বছর আগেও জীবনকে কিছুটা সামলানো সম্ভব মনে হতো। এখন জানতে ইচ্ছে করে—এই টানেলের শেষে আলো কোথায়?”
মধ্যবিত্ত শ্রেণির চাপ বাড়ার কারণ
মার্কিন মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে অফিসকর্মী, নার্স, প্লাম্বারসহ নানা পেশার মানুষ অন্তর্ভুক্ত। পিউ রিসার্চ সেন্টারের সংজ্ঞায়, পরিবারের বার্ষিক আয় ৬৬ হাজার ৬৬৬ ডলার থেকে ২ লাখ ডলার পর্যন্ত হলে তারা মধ্যবিত্ত হিসেবে গণ্য হতে পারে।
তবে লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি এই শ্রেণির মানুষের মধ্যে ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। তারা এখন আগের চেয়ে বেশি সাবধানে খরচ করছে এবং যেকোনো জায়গায় সাশ্রয়ের পথ খুঁজছে। জীবনযাত্রার ব্যয়ের এই সংকটই সাম্প্রতিক নির্বাচনে প্রভাব ফেলেছে; অনেকেই এমন প্রার্থীদের ভোট দিয়েছেন যারা ব্যয় কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
এই সমস্যা বাইডেনের গত নির্বাচনী প্রচারণাকে প্রভাবিত করেছিল এবং এখন ট্রাম্পের জনপ্রিয়তাকেও চাপে ফেলছে।

কোম্পানির আয়–ব্যয়ের চিত্রে মধ্যবিত্তের সংকট
অনেক বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জানাচ্ছে, মধ্যবিত্ত ভোক্তারা আগের মতো কেনাকাটা করছেন না।
উইংসটপ জানিয়েছে, মধ্যম–আয়ের ক্রেতারাও এখন ক্রয় কমিয়ে দিয়েছে, যা আগে ছিল নিম্ন আয়ের ক্রেতাদের প্রবণতা। টার্গেট জানিয়েছে, সাজঘর সামগ্রী থেকে পোশাক—সব ধরনের অপ্রয়োজনীয় খাতে তাদের বিক্রি কমেছে। বিপরীতে, ওয়ালমার্টে সব আয়ের গ্রাহকই সস্তা জিনিস কেনার জন্য ভিড় করছে।
মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভোক্তা মনোভাব জরিপ অনুসারে, মধ্যম আয়ের ৪৪ শতাংশ মানুষ মনে করেন তাদের আর্থিক অবস্থা গত বছরের তুলনায় খারাপ হয়েছে। মাত্র ২৩ শতাংশ মনে করেন পরিস্থিতি ভালো। অধিকাংশই উচ্চমূল্য বৃদ্ধিকে দায়ী করেছেন।
অন্যদিকে সমাজের উচ্চ–আয়ের মানুষ স্টক মার্কেটের উত্থান এবং আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের সুবিধা ভোগ করছে, যা গভীর বৈষম্য তৈরি করছে।
দৈনন্দিন জীবনে সাশ্রয়ের লড়াই
কনেকটিকাটের সাউথবুরির বাসিন্দা তেরি কাপ বলেন, “আমি ক্লান্ত।”
তেরি ও তার স্বামী বিল—যিনি এইচভিএসি টেকনিশিয়ান—মোট আয় করেন বছরে ১ লাখ ১৫ হাজার ডলার। তবুও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য তারা ঘরে অন্ধকারে কেবল এলইডি লাইট জ্বালিয়ে থাকেন। উৎসবের উপহার হিসেবে তিনি প্রিয়জনদের দেওয়ার জন্য পাথরে আঁকিবুঁকি আঁকার কথা ভাবছেন।

এ বছর তাদের একমাত্র ছুটি—মেইনে সড়ক ভ্রমণ—হয়েছে কেনাকাটার রিওয়ার্ডের ক্যাশব্যাকে ভরসা করে।
তেরি এখনো ১৫ হাজার ডলারের ক্রেডিট–কার্ড ঋণ শোধ করতে পারছেন না, যার বড় অংশই চিকিৎসা খরচের কারণে হয়েছে। পাশাপাশি মেয়ের স্নাতক শিক্ষার জন্য নেওয়া ৩০ হাজার ডলারের ঋণের বোঝাও রয়েছে—যদিও ডিগ্রি শেষ করার পরও ভালো চাকরি পাওয়া তাদের মেয়ের জন্য কঠিন হয়ে উঠেছে।
তিনি গত নভেম্বরে ট্রাম্পকে ভোট দেন, কারণ বাইডেনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা তাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। যদিও তিনি ট্রাম্পের কাজের প্রশংসা করেন, তবুও মনে করেন—ব্যয় কমানো ট্রাম্পের জন্য কঠিন হবে।
কেন হঠাৎ এত সমস্যা হলো
আগে বেশ কিছু বছর মধ্যবিত্তরা তুলনামূলক ভালো অবস্থায় ছিল। ২০০৮–০৯ আর্থিক সংকটের পর এক দশক ধরে পণ্যমূল্য বেশ স্থিতিশীল ছিল। সুদের হার ছিল কম, যার ফলে বাড়ি কেনা সুবিধাজনক ছিল। মহামারির পরে তারা সরকারি প্রণোদনা চেক পেয়েছিল এবং শিশু কর–ছাড়েও লাভবান হয়েছিল।
মুডিস অ্যানালিটিক্স জানায়, ২০২২ সালের শুরুর দিকে মধ্যবিত্তদের হাতে অতিরিক্ত ৫০০ বিলিয়ন ডলারের সঞ্চয় ছিল।
কিন্তু ২০২১ সালের বসন্তে মুদ্রাস্ফীতি বাড়তে শুরু করে এবং ২০২২ সালের জুনে ৯.১ শতাংশে পৌঁছায়। ২০২৫ সালের শুরুতে এই অতিরিক্ত সঞ্চয় প্রায় শেষ হয়ে যায়—মূলত টিকে থাকার খরচ মেটাতে গিয়ে।
বেতন বাড়লেও তার বেশিরভাগই মুদ্রাস্ফীতিতে মুছে গেছে।
দুর্দশায় শিক্ষক, তবুও কাজে স্থির
ভার্জিনিয়ার রিচমন্ডের কাছে বসবাসকারী ইংরেজি শিক্ষিকা কেট পেম্বারটন সম্প্রতি গভর্নর নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট আবিগেইল স্প্যানবার্গারকে ভোট দেন, কারণ তিনি আশা করেছিলেন শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধির মাধ্যমে জীবনযাত্রা সহজ হবে।
পেম্বারটন বছরে ৯০ হাজার ডলার আয় করেন—দিনে মধ্যবিদ্যালয়ে, রাতে উচ্চবিদ্যালয়ে পড়িয়ে। সপ্তাহের চার দিন সকাল ৭টার আগে স্কুলে পৌঁছান এবং দুপুরের দুই ঘণ্টা বিরতি ছাড়া রাত ৯টা ৩০ পর্যন্ত ক্লাস নেন।
কিন্তু তার ভাড়া আরও ১৫০ ডলার বাড়ছে, বীমা প্রিমিয়াম বাড়ছে ১৪৮ ডলার, আর তার কলেজ–পড়ুয়া মেয়ের খরচও বহন করতে হচ্ছে। ফলে তিনি প্রতি বেতনের মাত্র ৫০ ডলার অবসর তহবিলে জমাতে পারেন।
এ বছর তিনি নর্থ ক্যারোলিনার টপসেইল আইল্যান্ডে তাঁর বার্ষিক সমুদ্র–ভ্রমণ বাদ দিয়েছেন—তবুও খরচ কমানোর আর তেমন জায়গা নেই।
পেম্বারটন বলেন, “আমার মনে হয়, আমি বোধহয় মারা যাওয়া পর্যন্ত সপ্তাহে চার রাত পড়িয়েই যাব—অথবা অন্তত যতদিন না আমার মেয়ে অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য নতুন পোশাক চাইবে।”
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















