সারাক্ষণ রিপোর্ট 
সময়কাল এখন শেষের দিকে। এই কয়েকটি বছর ভিয়েতনামের জন্য ছিল অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জে ভরা। তবুও পার্টি সেন্ট্রাল কমিটি ও সরকারের দৃঢ় নেতৃত্ব দেশের সংকটকে সুযোগে পরিণত করেছে। সরকার, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় প্রশাসন নমনীয় ও সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে অর্থনীতিকে টিকিয়ে রেখেছে। মাসে মাসে, ত্রৈমাসিকে ত্রৈমাসিকে অর্থনীতি স্থিরভাবে এগিয়েছে। মজবুত হয়েছে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভিত্তি, নিয়ন্ত্রণে থেকেছে মুদ্রাস্ফীতি, আর উন্নত হয়েছে প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা।
বৈশ্বিক প্রতিকূলতার মধ্যেও দৃঢ়তা
সেমিনারের বিশ্লেষণ
নভেম্বরের একটি সেমিনারে বিশেষজ্ঞরা একমত হন যে, বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ ধাক্কার মধ্যেও ভিয়েতনাম দুর্দান্ত স্থিতিস্থাপকতা দেখিয়েছে। ভিয়েতনামে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির আবাসিক প্রতিনিধি রামলা খালিদি বলেন, ভিয়েতনাম সংকটকে সুযোগে রূপান্তর করেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে এবং মানব উন্নয়ন সূচকে ধারাবাহিক অগ্রগতি হয়েছে। সবকিছুর পেছনে রয়েছে শক্তিশালী নেতৃত্ব, সুস্পষ্ট কৌশল এবং জলবায়ু ঝুঁকির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সরকার পরিচালনার দক্ষতা।
অর্থনীতির স্থায়িত্ব
জাতীয় সংসদের অর্থনৈতিক ও আর্থিক কমিটির স্থায়ী সদস্য ড. ফান ডুক হিইউ বলেন, ভিয়েতনামের প্রবৃদ্ধি স্থায়ী হয়েছে কারণ অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সময়কালে সামগ্রিক প্রবৃদ্ধির গড় বেশ সন্তোষজনক থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। বেড়েছে অর্থনীতির পরিধি, বাণিজ্য প্রবাহ এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। সামষ্টিক সূচক গুলো স্থিতিশীল আছে।
তিনি উল্লেখ করেন—মহামারি, বৈশ্বিক বিনিয়োগ পুনর্বিন্যাস এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যনীতি—এসব কঠিন ধাক্কা মোকাবিলায় ভিয়েতনাম সফল হয়েছে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি, বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং বাণিজ্য বৃদ্ধিই এর প্রমাণ।
নেতৃত্ব, উদ্ভাবন ও সামাজিক অগ্রগতি
সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির লি কুয়ান ইউ স্কুল অব পাবলিক পলিসির অধ্যাপক ভু মিন খুয়াং বলেন, সময়কাল ছিল অসাধারণ। সাহস, সিদ্ধান্ত ক্ষমতা ও নিঃস্বার্থতা—এই তিন গুণ ভিয়েতনামের অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করেছে। উন্নত সামষ্টিক ভিত্তি দেশকে আন্তর্জাতিকভাবে আরও সম্মানজনক অবস্থানের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ডিজিটাল প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশ, দক্ষ মানব সম্পদ সৃষ্টি এবং প্লাস্টিক সহ বিভিন্ন শিল্পের বৈশ্বিক সংযুক্তি ভিয়েতনামের অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে ভিয়েতনাম দ্রুত অভিযোজিত হয়েছে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি শ্রমিক, বিশেষত নারী শ্রমিকদের সুরক্ষায় গুরুত্ব দিচ্ছে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় অগ্রগতি
রামলা খালিদি জানান, দারিদ্র্যের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। অধিকাংশ মানুষ স্বাস্থ্যবীমার আওতায় এসেছে, এবং প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত বিদ্যালয়ে ভর্তির হার বেড়েছে। এগুলো টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় ভিয়েতনামের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি।
অসমতা, পরিবেশ ও লিঙ্গসমতা—চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে
তবে চ্যালেঞ্জও রয়েছে। শহর ও গ্রামের মধ্যে বৈষম্য, ডিজিটাল সুবিধায় ফারাক, এবং প্রাদেশিক পর্যায়ে নারীর নেতৃত্ব কমে যাওয়া—এসব উদ্বেগজনক। পরিবেশগত বিপর্যয় ও বড় হুমকি; জলবায়ু পরিবর্তন প্রতি বছর ভিয়েতনামের বিপুল ক্ষতি করছে।
রামলা খালিদি ভবিষ্যতের জন্য তিনটি অগ্রাধিকার তুলে ধরেন—
উদ্ভাবন ও সবুজ রূপান্তর
মানবসম্পদ উন্নয়ন
প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার
পাঁচ বছরের শিক্ষা: ভবিষ্যতের গতিপথ
ড. হিইউ তিনটি কৌশলগত শিক্ষা তুলে ধরেন—
প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য বাড়লে চ্যালেঞ্জ বাড়ে, তাই অভিযোজন জরুরি।
প্রবৃদ্ধির পরিমাণের পাশাপাশি গুণগত মান ও স্থায়িত্ব সমান গুরুত্বপূর্ণ।
সংস্কারের গতি বজায় রাখা সবচেয়ে জরুরি।
সংকট মোকাবিলায় সরকারের সক্রিয় ভূমিকা
মহামারির সময় সরকার দ্রুত বিশেষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। শুধু মহামারি নিয়ন্ত্রণ নয়, অর্থনীতিও বাঁচানোর কৌশল গ্রহণ করা হয়। আইন প্রণয়নের গতি বাড়ানো হয়, এমনকি অল্প সময়ে বেসরকারি খাত উন্নয়নবিষয়ক একটি গুরুত্বপূর্ণ রেজোলিউশন আইনে পরিণত হয়। তিনি জোর দিয়ে বলেন, নীতিনির্ধারণে মানুষের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে।
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা
প্রফেসর খুয়াং বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্কসংক্রান্ত আলোচনার মতো ঘটনায় ভিয়েতনাম সংকটকে সুযোগে পরিণত করেছে। ভবিষ্যতের জন্য তিনি পরামর্শ দেন—
প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি কৌশলগত বিবর্তন নিশ্চিত করা
ঝুঁকির উৎস চিহ্নিত করে তা দূর করা
অঞ্চলভিত্তিক ও খাতভিত্তিক সমন্বিত উন্নয়নের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য ফল সৃষ্টি করা
হানয়, হো চি মিন সিটি ও দা নাং—এই তিন শহরে বিনিয়োগ ও মানবসম্পদ উন্নয়ন ভিয়েতনামের পরবর্তী উন্নয়নের মূল চালিকা শক্তি হবে।
অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের ভিত্তি
ভিয়েতনাম আগামী সময়ে উচ্চ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নিয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রবৃদ্ধি শুধু দ্রুত হওয়া নয়—টেকসই, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানভিত্তিক হতে হবে।
ড. খুয়াং বলেন, বিশ্বব্যাপী উচ্চ প্রবৃদ্ধি সবসময় গঠনমূলক সংস্কারের ফল। তাই ভিয়েতনামকে উচ্চমানের উন্নয়নে যেতে হলে শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করতে হবে।
রামলা খালিদি বলেন, শুধু প্রবৃদ্ধির হার নয়—সকল মানুষের উন্নয়ন নিশ্চিত করাই প্রধান লক্ষ্য। নীতি বাস্তবায়নে নমনীয়তা, উদ্ভাবন ও অভিযোজনশীলতা জরুরি।
সামাজিক ভিত্তি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
জাতীয় সংসদের সামাজিক বিষয়ক কমিটির সাবেক উপ-চেয়ারম্যান ড. বুই শি লই বলেন, দ্রুত প্রবৃদ্ধিকে টেকসই করতে হলে শক্তিশালী সামাজিক ভিত্তি দরকার। জনগণের অংশগ্রহণ, ন্যায়বিচার, মানবকেন্দ্রিক উন্নয়ন এবং দক্ষ জনশক্তি—সবই জরুরি।
বিশেষজ্ঞরা একমত যে, চ্যালেঞ্জ নতুন সুযোগ তৈরি করে। কাঁচামাল রপ্তানি থেকে সরে এসে উচ্চ মূল্য সংযোজিত পণ্য উৎপাদন, মানবসম্পদ উন্নয়ন, সৃজনশীলতা বৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক বাজারের সঙ্গে গভীর সংযোগ—এসবই ভিয়েতনামকে আরও টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের পথে এগিয়ে নেবে।
#feature #sarakhan
