রাজধানী থেকে জেলা শহর—সবখানেই চাঁদাবাজি যেন অনিয়ন্ত্রিত ‘মহামারি’। ব্যবসায়ী, পরিবহনকর্মী, বাজারের দোকানি থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতারাও এখন সন্ত্রাসীদের চাঁদার ভয় ও হুমকির মুখে। সরকার–পরিবর্তনের পর নতুন চক্র মাথা তুলেছে; তালিকায় প্রতিটি জেলায় বেড়েছে চিহ্নিত চাঁদাবাজের সংখ্যা।
চক্রের হুমকিতে পঙ্গু জীবন
পল্লবীর এক ব্যবসায়ী জানালেন, চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় তিনি এখন পরিবারসহ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। শুধু তাঁর ঘটনা নয়—গত বছরের ৫ আগস্টের পর সারাদেশেই চাঁদাবাজি বেড়েছে ভয়াবহভাবে।
চট্টগ্রাম ইপিজেডের এক কারখানার মালিক (ছদ্মনাম রাশেদ খান) জানান, চাঁদা না দেওয়ায় তাঁকে দীর্ঘদিন ধরে সামাজিক মাধ্যমে ধারাবাহিক মানহানির শিকার হতে হচ্ছে।
একজন স্বনামধন্য নারী উদ্যোক্তা (ছদ্মনাম মেহরীন সাদিয়া) জানান, নগরের এক শীর্ষ সন্ত্রাসী তাঁর কাছে এক কোটি টাকা চেয়েছে এবং চাঁদা না পেয়ে পরিবারসহ হত্যার হুমকি দিচ্ছে।
ফুটপাত ও বাজারে প্রতিদিনের চাঁদা
সরেজমিনে রাজধানীর কারওয়ানবাজার, গুলিস্তান, নিউমার্কেট, মিরপুর, মতিঝিল, পুরান ঢাকা ও আরও কয়েকটি এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে—হকারদের প্রতি দিন ১০০–৫০০ টাকা দিতে হচ্ছে।
এক হকার্স সমিতির নেতা (ছদ্মনাম সাহেব আলী) জানান, ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতিদিন বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে হুমকি দিয়ে।
রাজনৈতিক পরিচয়ে দৌরাত্ম্য
চাঁদাবাজদের অনেকেই পুরনো দলের কর্মী বা নতুন দলের নেতা। বড় নেতাদের নাম ভাঙিয়েও চাঁদা আদায় চলছে। শহর থেকে উপজেলা—সব জায়গায় একই চিত্র।
পুলিশ এ পর্যন্ত অনেককে গ্রেপ্তার করলেও প্রবণতা কমছে না।

দেশজুড়ে অর্ধলক্ষাধিক চিহ্নিত চাঁদাবাজ
এক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র জানায়, গত কয়েক মাসে দুই হাজার ৩২৫টির বেশি চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া গেছে, যার বেশির ভাগের সঙ্গে স্থানীয় রাজনৈতিক পরিচয়ধারীদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের তালিকা অনুযায়ী রাজধানীতে আড়াই হাজারের বেশি চিহ্নিত চাঁদাবাজ আছে। সারাদেশের তালিকা মিলিয়ে সংখ্যা অর্ধলক্ষাধিক।
ডিএমপির হালনাগাদ তালিকা
পল্লবী থানায় ৬৬ জন এবং মোহাম্মদপুর থানায় ১২৫ জন চিহ্নিত চাঁদাবাজের তালিকা ধরে তদন্ত চলছে।
ডিএমপি কমিশনারজানান, ‘চাঁদাবাজির কারণে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তালিকা হালনাগাদ করা হচ্ছে।’
গ্রেপ্তার ও মামলা বৃদ্ধি
চাঁদাবাজির ঘটনায় গত ১০ মাসে এক হাজারের বেশি গ্রেপ্তার হয়েছে। জুলাই–আগস্টে আট বিভাগে গ্রেপ্তার হয় ৬৫০ জন। শুধু ডিএমপিতেই ছয় মাসে ৪১৯টি মামলা হয়েছে।
আইজিপি বলেন, অভিযান অব্যাহত আছে।
সরকার পরিবর্তনের পর নতুন চক্র সক্রিয়
অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের ক্ষমতার পরিবর্তনের পর আইন–শৃঙ্খলা নাজুক হয়ে পড়ে। পুরনো চক্র দুর্বল হওয়ায় নতুন দল মাথা তোলে। রাজনৈতিক পরিচয়, গ্যাং সংস্কৃতি ও স্থানীয় দাপটকে কাজে লাগিয়ে চাঁদাবাজি আরও বৃদ্ধি পায়।
চাঁদা না পেয়ে শতাধিক খুন
তথ্য বলছে, ১৪ মাসে দেশজুড়ে শতাধিক মানুষ চাঁদাবাজদের হাতে খুন হয়েছে। রাজধানীতে সংখ্যা অন্তত ২০।
মগবাজার, মতিঝিল, গুলশানসহ কয়েকটি এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসীদের আধিপত্য বেশি।
বাড্ডায় একটি রাজনৈতিক দলের নেতা (ছদ্মনাম রিফাত কামাল) হত্যার পেছনেও ছিল চাঁদাবাজ চক্রের দ্বন্দ্ব।
হাতিরঝিলে ছাত্র সংগঠনের সদস্য (ছদ্মনাম আদনান নাসির) হত্যার নেপথ্যেও একই কারণ।
রাজনৈতিক পরিচয়ে শুরু হওয়া চাঁদাবাজি
৫ আগস্টের পর বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিচয়ধারী নেতা–কর্মীর ছদ্মবেশে চাঁদাবাজি বেড়ে যায়।
এক ব্যবসায়ী (ছদ্মনাম সাইফুল রহমান) বলেন, একজন স্থানীয় যুবক তাঁর কাছে চাঁদা দাবি করছে এবং হুমকি দিয়েছে।
কারওয়ান বাজারের এক ব্যবসায়ী (ছদ্মনাম ইউসুফ আলী) জানান, গত আগস্টের পর তাঁকে বারবার চাঁদা দিতে হয়েছে, এখন আরও বেশি টাকা দাবি করা হচ্ছে।
পরিবহনে দৈনিক কোটি টাকার চাঁদা
ঢাকার ৫৩টি পরিবহন টার্মিনাল ও স্ট্যান্ডে প্রতিদিন দুই কোটিরও বেশি টাকা চাঁদা আদায় হয়। মাস শেষে তা ৬০–৮০ কোটি টাকায় পৌঁছে।
ড্রাইভাররা বলেন, চাঁদা না দিলে গাড়ি আটকে রাখা হয়, রুট বন্ধ করে দেওয়া হয়।

হাট–বাজারে প্রকাশ্য চাঁদাবাজি
বাজার নিয়ন্ত্রণের নামে দোকানপ্রতি ৫০–৫০০ টাকা ‘হিসাব’ দিতে হয়। অস্বীকৃতি জানালে পণ্য পরিবহন বন্ধ, দোকান ভাঙচুর বা হামলার মতো ঘটনা ঘটে।
রাজনৈতিক পরিবারের সদস্যের অভিযোগ
এক রাজনৈতিক নেতার পুত্রবধূ (ছদ্মনাম নাদিয়া রহমান) ডিএমপি হাতিরঝিল থানায় চাঁদাবাজির অভিযোগ করেছেন। তদন্ত চলছে।
গাড়ি বিক্রেতাদের হুঁশিয়ারি
গাড়ি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বারভিডার সদস্যরা বারিধারায় মানববন্ধন করে বলেন, বহুদিন ধরে চাঁদাবাজি চলছে, ব্যবস্থা না নিলে গাড়ি ছাড় এবং নিবন্ধন বন্ধ করে দেবেন।
বারভিডা সভাপতি জানান, তাদের কাছে অজানা নম্বর থেকে চাঁদা দাবি করা হয়, এমনকি অস্ত্রের ছবি পাঠিয়ে ভয় দেখানো হয়। ১২টি শোরুমে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে।
র্যাব কর্মকর্তা বলেন, ‘চাঁদাবাজদের ধরতে অভিযান চলছে।’
চাঁদাবাজির মূল পাঁচ চক্র
গোয়েন্দারা সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে পাঁচটি গোষ্ঠীকে মূল হোতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন—
১) কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তি
২) আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি অংশ
৩) প্রশাসনের ভেতরের স্বার্থান্ধ গোষ্ঠী
৪) স্থানীয় সন্ত্রাসী ও বাহিনী
৫) পেশাজীবী সংগঠনের নেতাদের চক্র
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















