নাইজেরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের ইডো অঙ্গরাজ্যের রাজধানী বেনিন সিটি আজও ব্রোঞ্জ ও পিতলের কাজের ঐতিহ্যের জন্য বিশ্বজোড়া খ্যাতি ধরে রেখেছে। এখানে শত শত বছর ধরে ব্রোঞ্জ ঢালাইয়ের যে কৌশল চালু আছে, তা আজও টিকে আছে—যদিও খরচ বৃদ্ধি, শিল্পী সংকট এবং আধুনিকতার চাপে এই শিল্প এখন সংগ্রামের মধ্যে।
বেনিন সিটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব
একসময় প্রাচীন বেনিন সাম্রাজ্যের কেন্দ্র ছিল বেনিন সিটি। এখানকার রাজপ্রাসাদে স্থাপিত বিখ্যাত ব্রোঞ্জের মূর্তি ও ফলক ১৮৯৭ সালে ব্রিটিশ আক্রমণের পর লুট হয়ে যায় এবং বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন জাদুঘর ও ব্যক্তিগত সংগ্রহে ছড়িয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্রিটেন, জার্মানি ও নেদারল্যান্ডসসহ কয়েকটি দেশ শতাধিক নিদর্শন নাইজেরিয়ায় ফেরত পাঠিয়েছে।
পুরনো কৌশলে ব্রোঞ্জ ঢালাই
দীর্ঘ লোহার চিমটা হাতে ভিক্টর উইনমওয়েন আদুয়ে ও ম্যাথিউ ম্যাথিয়াস জ্বলন্ত আগুনের ভেতর রাখা পাত্র থেকে গলিত ধাতু তুলে মাটির নিচে পুঁতে রাখা ছাঁচে ঢেলে দেন। ঠান্ডা হওয়ার পর মাটি খুঁড়ে ছাঁচটি খুললে দেখা যায় তিনটি ছোট ব্রোঞ্জ মাথা—প্রাচীন বেনিন সাম্রাজ্যের এক সম্রাটের প্রতিরূপ।
ইগুন স্ট্রিট: ব্রোঞ্জ শিল্পের প্রাণকেন্দ্র
বেনিন সিটির ইগুন স্ট্রিটে অবস্থিত বেনিন ব্রোঞ্জ কাস্টারদের গিল্ড একসময় ছিল সমৃদ্ধশালী সংগঠন। এখানকার প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে দোকানে দোকানে সাজানো থাকে ব্রোঞ্জের বিভিন্ন মূর্তি ও অলংকার—সবই স্থানীয় শিল্পীদের হাতে তৈরি।
গিল্ডের সদস্যরা প্রজন্ম ধরে বাবা থেকে ছেলের কাছে কাজের কৌশল শিখে আসছেন। ৪৫ বছরের আদুয়ে ছয় বছর বয়সে তার বাবার কাছেই এই কাজ শেখেন। তিনি বলেন, গ্রাহক যা চান তা বানাতে পারেন, কিন্তু রাজা-রানির প্রতিকৃতি বানানোই তাকে সবচেয়ে বেশি আনন্দ দেয়।

রানী ইদিয়ার মূর্তি নির্মাণ
দুই বছর আগে আদুয়ে ১০ মিটার (৩২ ফুট) উঁচু রানী ইদিয়ার মূর্তি তৈরির দলে ছিলেন। এই মূর্তিটি এখন বেনিন সিটির একটি ব্যস্ত রাউন্ডআবাউটকে শোভা দিচ্ছে।
রানী ইদিয়া ছিলেন বেনিনের প্রথম “কুইন মাদার”—১৬শ শতকের শক্তিশালী যোদ্ধা ও প্রভাবশালী নারী, যিনি তার পুত্র ওবা এসিগিয়ে-কে সিংহাসনে বসাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
মূর্তিটি তৈরি করতে ছয় মাস লেগেছিল এবং কাজটি সম্পূর্ণ গোপনে করা হয়, কারণ ওবা (স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী শাসক) শেষ না হওয়া পর্যন্ত কাউকে মূর্তিটি দেখতে দিতে চাননি।
গিল্ডের সংকট: খরচ বৃদ্ধি ও সদস্য কমে যাওয়া
একসময় ওবার পৃষ্ঠপোষকতায় সমৃদ্ধ গিল্ডে এখন মাত্র ১২০ জন সদস্য। গিল্ড প্রধান কিংসলে অসারহেনহেন ইন্নেহ, যিনি আদুয়ের চাচা, জানান—অনেক সদস্যই আয়ের অভাবে অন্য পেশায় চলে গেছেন।
পিতলের দাম গত চার বছরে ৬০০ নাইরা থেকে বেড়ে ৮,০০০ নাইরায় পৌঁছেছে, যা তাদের জন্য বড় চাপ। অনেক সময় ভাঙারি গাড়ি থেকে উদ্ধার করা পিতলই ব্যবহার করতে হয়।
ইন্নেহ আধুনিক যন্ত্রপাতির জন্য আর্থিক সহায়তার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন এবং আশা রাখেন যে তার দুই ছেলে ভবিষ্যতে এই ঐতিহ্য ধরে রাখবে।
আগুনে দক্ষতা অর্জনের গল্প
উত্তর নাইজেরিয়া থেকে আসা ৪৩ বছরের ম্যাথিউ ম্যাথিয়াস এক দশক আগে বেনিন সিটিতে এসে এক কাস্টার থেকে এ শিল্প শেখেন। তিনি বলেন, তারা তাকে পরিবারের সদস্যের মতো গ্রহণ করেছে।
তার মতে, আগুনের সঙ্গে কাজ করা মানুষকে সাহসী করে তোলে—”এই উত্তাপ জীবনের কষ্টের মতো; যদি এ উত্তাপ সহ্য করতে পারি, সমাজের কঠিন বাস্তবতাও সামলাতে পারব।”

নতুন ধারায় কেলি ওমোদামওয়েনের শিল্প
অন্যদিকে ৩২ বছরের শিল্পী কেলি ওমোদামওয়েনও পুরনো কৌশলেই ব্রোঞ্জ ঢালাই করেন, তবে তিনি মিনিমালিস্ট শৈলীতে কাজ করেন। স্থানীয় পুরাণ ও ইতিহাস থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি সহজ আকারে গল্প বলতে পছন্দ করেন। তার কাজ ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রেও বিক্রি হয়েছে।
তিনি বলেন, “যখনই নতুন কিছু করার চেষ্টা করেছি, শেষ পর্যন্ত আবার এই গল্পগুলোর কাছেই ফিরে এসেছি।”
চাপ, ব্যয়বৃদ্ধি ও নতুন প্রজন্মের অনাগ্রহ সত্ত্বেও নাইজেরিয়ার ব্রোঞ্জ শিল্পীরা এখনো শতাব্দীপ্রাচীন ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রেখেছেন। ইতিহাস, সংস্কৃতি ও পরিচয়ের এই শিল্প আজও বেনিন সিটিতে আগুনের তাপে, শিল্পীর হাতে এবং মানুষের ভালোবাসায় বেঁচে আছে।
#t সংস্কৃতি শিল্প #নাইজেরিয়া #ব্রোঞ্জ_শিল্প #বেনিন_সিটি #ঐতিহ্য শিল্পীরা #PressReader KuwaitTimes
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















