বৈধ শিল্প থেকে অবৈধ অর্থনীতিতে চীনের উত্থান
চীনা কোম্পানিগুলো যেমন ইস্পাত, জাহাজ নির্মাণ, ব্যাটারি, ইলেকট্রিক গাড়ি—প্রায় প্রতিটি বৈধ শিল্পেই বিশ্ববাজার দখল করেছে, ঠিক তেমনভাবেই চীনের আন্ডারগ্রাউন্ড আর্থিক নেটওয়ার্ক এখন আন্তর্জাতিক মানি লন্ডারিং জগতের প্রধান শক্তিতে পরিণত হয়েছে। এসব নেটওয়ার্ক ধনী চীনা নাগরিক, মেক্সিকান মাদক কার্টেল এবং উত্তর কোরীয় সাইবার হ্যাকারদের অর্থ পাচারে সহায়তা করে—সবই কোনো সরাসরি সাক্ষাৎ ছাড়া। মার্কিন ট্রেজারি বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ১৫৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিমাণ অবৈধ অর্থ চীনা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পাচার হয়। এই পরিমাণই প্রমাণ করে যে আমেরিকায় অবৈধ মাদক ব্যবসা থেকে উৎপন্ন অর্থের সিংহভাগই চীনা নেটওয়ার্কের হাত ঘুরে যায়। ফিনান্সিয়াল ক্রাইমস এনফোর্সমেন্ট নেটওয়ার্কের পরিচালক অ্যান্ড্রিয়া গ্যাকি সতর্কবার্তা দিয়ে জানিয়েছেন যে এই নেটওয়ার্কগুলি বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত এবং অত্যন্ত জটিল।
চীনা নেটওয়ার্কের বিস্তার ও দ্রুততা
পূর্ববর্তী মানি লন্ডারিং পদ্ধতির তুলনায় চীনা নেটওয়ার্ক গতি, দক্ষতা এবং সর্বনিম্ন ফি প্রদানের মাধ্যমে প্রতিযোগীদের সরিয়ে দিয়েছে। আগে মেক্সিকান কার্টেলগুলো ব্ল্যাক মার্কেট পেসো এক্সচেঞ্জ ব্যবহার করত, যেখানে সহিংসতা এবং আইনশৃঙ্খলার ঝুঁকি ছিল বাড়তি। ফি ছিল ৭ থেকে ১০ শতাংশ। এখন চীনা নেটওয়ার্ক মাত্র ১ থেকে ২ শতাংশ ফি নেয়, যা পুরনো নেটওয়ার্ককে কার্যত অচল করে দিয়েছে। একইসঙ্গে এদের পরিসরও অভূতপূর্ব। উত্তর কোরীয় হ্যাকাররা একসময় ইতিহাসের বৃহত্তম ক্রিপ্টোকারেন্সি ডাকাতিতে ১.৫ বিলিয়ন ডলার চুরি করেছিল, যা প্রতিদিন ১০ কোটি ডলার হারে পাচার করা হয় বলে তদন্তকারী প্রতিষ্ঠান TRM জানায়। এ ধরনের অপারেশন চীনা আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যাংকারদের প্রযুক্তিগত সহায়তা ছাড়া প্রায় অসম্ভব।
কঠোর ক্যাপিটাল কন্ট্রোল এবং বাণিজ্য প্রবাহের সুযোগ
এই নেটওয়ার্কের সাফল্যের পেছনে প্রধান কারণ হলো প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের পাশাপাশি চীনের বিশাল বাণিজ্য উদ্বৃত্ত এবং কঠোর মূলধন নিয়ন্ত্রণ। চীনে বছরে একজন ব্যক্তি ৫০ হাজার ডলারের বেশি বিদেশে নিতে পারেন না। ফলে বৈধ চাহিদা ও অবৈধ সরবরাহ মিলিয়ে তৈরি হয়েছে তিনমুখী পাচারচক্র। এতে আমেরিকার অবৈধ মাদক অর্থ, চীনা নাগরিকদের বিদেশে অর্থ পাঠানোর চাহিদা এবং কার্টেলগুলোর পছন্দের মুদ্রা একই ব্যবস্থার মাধ্যমে লেনদেন হয়। এই তিনটি প্রবাহ একসঙ্গে মিলে তৈরি হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে সুসংগঠিত মানি লন্ডারিং চক্র।

মিরর ট্রান্সাকশন: অর্থ না সরিয়েই পাচারের কৌশল
মিরর ট্রান্সাকশন হলো এই নেটওয়ার্কগুলোর সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। এতে কোনো অর্থ আন্তর্জাতিক সীমান্ত পেরোয় না। মাদক কার্টেল আমেরিকায় মাদক বিক্রি করে ডলার পায়। একই সময়ে সাংহাইয়ের একটি পরিবার বিদেশে সম্পত্তি কেনার জন্য দালালকে রেনমিনবি দেয়। দালাল নিউইয়র্কে তাদের অ্যাকাউন্টে সমপরিমাণ ডলার পাঠিয়ে দেয়। এতে বিদেশে অর্থ পাঠানোর আইনও ভাঙা হয় না, আবার মাদকের অর্থও সাদা হয়ে যায়। দালাল এরপর চীনে পাওয়া রেনমিনবি ব্যবহার করে মাদককার্টেলকে পছন্দের মুদ্রায় পরিশোধ করে। কখনো ফেনট্যানিল তৈরির রাসায়নিক কেনা হয়, কখনো বৈধ পণ্য রপ্তানি করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় কোনো নথি একে অপরের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা সম্ভব নয়। সব যোগাযোগই এনক্রিপ্টেড মেসেজিং অ্যাপের মাধ্যমে, যা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য নজরদারিকে আরও কঠিন করে তুলেছে।
বহুজাতিক বিস্তার ও কেন এগুলো ধরা কঠিন
কোলম্বিয়ান কার্টেলগুলোর মতো এগুলো ধ্বংস করা সহজ নয়, কারণ চীনা নেটওয়ার্ক বহু দেশজুড়ে ছড়ানো এবং বিভিন্ন আর্থিক ব্যবস্থার ফাঁকফোকর কাজে লাগায়। এরা ধনী গ্রাহক ও অপরাধী উভয়কেই সেবা দেয়, যা তাদের আরও শক্তিশালী করে। শুধু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনা গোষ্ঠীগুলোর পরিচালিত অনলাইন প্রতারণা শিল্প থেকেই বছরে প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলার উৎপন্ন হয়। এই বিপুল অর্থ আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যাংকিং নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সাদা করা হয়, যা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য এক বৃহৎ চ্যালেঞ্জ।
প্রিন্স গ্রুপ: বৈধ ব্যবসার আড়ালে অবৈধ অর্থ
২০২৪ সালের অক্টোবরে মার্কিন কর্তৃপক্ষ কম্বোডিয়ার ব্যবসায়ী চেন ঝির বিরুদ্ধে অভিযোগ দেয়। তিনি প্রিন্স গ্রুপ নামে একটি প্রতিষ্ঠান চালাতেন, যা বাইরে থেকে রিয়েল এস্টেট ও আর্থিক সেবা প্রদানকারী হলেও অভিযোগ অনুসারে এশিয়ার বৃহৎ অপরাধ নেটওয়ার্কগুলোর একটি। ২০১৮ সাল থেকেই তাদের অনলাইন প্রতারণা প্রতিদিন প্রায় ৩ কোটি ডলার আয় করত। ২০২০ সালে চেনের হাতে থাকা ১,২৭,২৭১ বিটকয়েনের মূল্য ছিল ১৫ বিলিয়ন ডলার। অভিযোগ অনুসারে তিনি অর্থ সাদা করতে ব্যবহার করতেন ক্রিপ্টো মাইনিং, অনলাইন জুয়া, শেল কোম্পানি এবং পেশাদার মানি লন্ডারিং চক্র। চেন এবং তার প্রতিষ্ঠান অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

হুইওয়ান গ্যারান্টি: প্রতারকদের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম
২০২১ সালে চালু হওয়া হুইওয়ান গ্যারান্টি অনলাইন মার্কেটপ্লেসটি বৈধভাবে সম্পত্তি, গাড়ি ও অন্যান্য পণ্য বেচাকেনা করলেও এর আড়ালে ছিল প্রতারকদের জন্য এক ডিজিটাল অপরাধবাজার। বিলিয়ন ডলার এ প্ল্যাটফর্মে ঘুরে বেড়াত। মার্কিন ট্রেজারি এটিকে উত্তর কোরীয় সাইবার ডাকাতদের অর্থ সাদা করার ‘গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র’ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং ২০২৫ সালে এর ব্যাংকিং প্রবেশাধিকার বন্ধ করে।
মানি মিউল: দরিদ্র মানুষের আর্থিক পরিচয় ব্যবহারের কৌশল
অনেক ক্ষেত্রে চক্রগুলো নগদ অর্থকে বৈধ ব্যাংকিং ব্যবস্থায় প্রবেশ করাতে দরিদ্র বা তরুণদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে। সিঙ্গাপুরে ‘ড্যানিয়েল’ নামের এক তরুণ বন্ধুর পরামর্শে অ্যাকাউন্ট খুলে কয়েকশ ডলারের বিনিময়ে মানি মিউল হয়ে যান। কিছুদিনের মধ্যেই তার অ্যাকাউন্টে লক্ষ লক্ষ ডলারের লেনদেন দেখা যায়। তার কয়েক বন্ধু এ কারণে কারাগারে গেছে। ব্রিটেনে চীনা অপরাধী চক্রগুলো শিক্ষার্থীদেরও একইভাবে ব্যবহার করে। কখনো দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যাংককর্মীরা ভুয়া ঠিকানায় অ্যাকাউন্ট খুলে দেয়।
উত্তর ও ভবিষ্যত চ্যালেঞ্জ
আমেরিকা ও ব্রিটেন কিছু নেটওয়ার্ক ধরতে সফল হলেও পুরো কাঠামো ভেঙে ফেলা কঠিন। কারণ এই অপরাধ দমনে চীনের সক্রিয় সহযোগিতা প্রয়োজন, যা বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে খুবই সীমিত। ফলে এই আন্ডারগ্রাউন্ড নেটওয়ার্কগুলোকে সম্পূর্ণরূপে থামানো এখনো দূর লক্ষ্য।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















