ইংল্যান্ডের বাজেট ঘোষণায় নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এখন থেকে স্থানীয় মেয়ররা ভ্রমণকারীদের ওপর ‘ট্যুরিস্ট ট্যাক্স’ আরোপ করতে পারবেন। এই সিদ্ধান্ত বিশেষ করে লন্ডনসহ বড় শহরগুলোতে ভ্রমণ করতে যাওয়া সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) নাগরিকদের ভ্রমণ ব্যয় কিছুটা বাড়িয়ে দিতে পারে। নতুন কর নীতিটি বৃহত্তর রাজস্ব সংগ্রহ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আনা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে বেতন থেকে পেনশনে অতিরিক্ত সুবিধা নেওয়ার ক্ষেত্রেও সীমা নির্ধারণ এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে বাড়তি কর আরোপ করার ক্ষমতা দেওয়া।
পর্যটক কর কেমন হবে: পরামর্শ চলছে
সরকার জানিয়েছে, ট্যুরিস্ট ট্যাক্স কীভাবে কার্যকর হবে তা নির্ধারণে পরামর্শ গ্রহণ করা হচ্ছে। করটি নির্দিষ্ট রাতপ্রতি হার হবে নাকি থাকার খরচের একটি শতাংশ—এ নিয়েও আলোচনা চলছে। গণমাধ্যমে ধারণা দেওয়া হয়েছে, সম্ভাব্য হার রাতপ্রতি প্রায় ২ পাউন্ড (প্রায় ৯.৪০ দিরহাম) হতে পারে। এটি হোটেল ও এয়ারবিএনবিসহ স্বল্পমেয়াদি ভাড়ার ওপর প্রযোজ্য হবে।
লন্ডনে শতাংশভিত্তিক করের সম্ভাবনা
লন্ডন চাইলে রাতপ্রতি নির্দিষ্ট হারের পরিবর্তে শতাংশভিত্তিক কর চালু করতে পারে, যা প্রিমিয়াম হোটেল থেকে বেশি রাজস্ব আসার সুযোগ তৈরি করবে। সিটি হল বলছে, এই কর চালু হলে বছরে অন্তত ২০০ মিলিয়ন পাউন্ড আয় হতে পারে, যা দিয়ে স্থানীয় সেবা ও পর্যটন অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করা সম্ভব।

লন্ডনের মেয়র সাদিক খান দীর্ঘদিন ধরে কেন্দ্রীয় কোষাগার থেকে কর আরোপের ক্ষমতা পাওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। তাঁর মতে, এই কর সরাসরি লন্ডনের অর্থনীতিকে সহায়তা করবে।
লিভারপুলের মেয়র স্টিভ রদারহ্যামসহ অন্যান্য শহরের মেয়ররাও একই ক্ষমতা চান। তাঁদের বক্তব্য, বার্সেলোনা ও প্যারিসের মতো শহরগুলো পর্যটক কর থেকে লাখ লাখ ইউরো আয় করে; কিন্তু ব্রিটিশ শহরগুলোকে তুলনামূলক কম সুবিধা নিয়ে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় নামতে হয়।
হোটেল খাতের উদ্বেগ
যুক্তরাজ্যের হসপিটালিটি খাত মনে করছে, নতুন কর আরোপ করলে চাহিদা কিছুটা কমতে পারে এবং পরিবারগুলোর মোট ভ্রমণ ব্যয় বাড়বে। যুক্তরাজ্যের হসপিটালিটি চিফ এক্সিকিউটিভ কেট নিকলস ব্লুমবার্গকে বলেন, এটি ‘‘ব্রিটিশ সাগরতীর ভ্রমণ, শহর ভ্রমণ এবং পরিবার ও বন্ধুদের কাছে যাওয়া—সব কিছুর ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি করবে।’’

ইউএই থেকে যারা লন্ডন ভ্রমণে যান, তাঁদের জন্যও করটি অল্প হলেও ব্যয়ের চাপ বাড়াবে। তবে হার, কাঠামো এবং প্রয়োগের তারিখ—সবকিছুই পরামর্শ শেষে নির্ধারিত হবে।
বাজেটে ব্রিটিশ প্রবাসীদের আগ্রহ
যুক্তরাজ্যের এই নতুন বাজেট ইউএই-ভিত্তিক ব্রিটিশ প্রবাসীদের মধ্যেও ব্যাপক আগ্রহ তৈরি করেছে। কারণ বাজেটের বিভিন্ন পদক্ষেপ যুক্তরাজ্যে বসবাসকারীদের ব্যক্তিগত করের চাপ বাড়াবে, অথচ দেশের বাইরে অবস্থানকারীরা তুলনামূলকভাবে সুরক্ষিত থাকবেন।
পরামর্শকরা বলছেন, এই পার্থক্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার ক্ষেত্রে উপসাগরীয় অঞ্চল—বিশেষ করে ইউএই—কে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে পারে। বাজেটে বিদেশে বসবাসকারী ব্রিটিশদের জন্য স্বেচ্ছা জাতীয় বিমা (ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স) অবদান বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, যারা বিদেশে থাকাকালীন যুক্তরাজ্যের ইন্ডিভিজুয়াল সেভিংস অ্যাকাউন্ট (আইএসএ) ধরে রাখেন, তাঁদের জন্য ভবিষ্যতে জটিলতা বাড়তে পারে।
প্রবাসীদের সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলতে পারে
এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে সেন্ট জেমস প্লেসের কর ও প্রযুক্তি বিভাগের প্রধান টনি স্মিথ বলেন, এসব পরিবর্তন আন্তর্জাতিকভাবে চলাফেরা করা পরিবারগুলোর দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায় প্রভাব ফেলতে পারে।

তাঁর ভাষায়, ‘‘অনেকে এখন তাঁদের পেনশন বা আইএসএ সম্পর্কিত পরিকল্পনা নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য হতে পারেন। কারণ জাতীয় বিমার স্বেচ্ছা অবদান বাড়লে ভবিষ্যতে যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রীয় পেনশনের যোগ্যতা বজায় রাখতে খরচও বাড়বে।’’
তিনি আরও বলেন, একক কোনো নীতিগত পরিবর্তন সাধারণত কাউকে স্থান পরিবর্তনে বাধ্য করে না, তবে উপসাগরীয় অঞ্চলের স্থিতিশীল ও স্বচ্ছ করব্যবস্থা অনেক পরিবারের কাছে আকর্ষণীয়।
‘‘বিশেষ করে দুবাইয়ে করনীতি সহজ, পূর্বানুমানযোগ্য এবং নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা শক্তিশালী—এ কারণে সীমান্তপারের আর্থিক পরিকল্পনায় এখানকার প্রতি আগ্রহ আরও বাড়বে,’’ বলেন স্মিথ।
যুক্তরাজ্যে কর বৃদ্ধি: বাজেটের বড় সিদ্ধান্ত
ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রী রেচেল রিভস এ বাজেটে মোট ২৬ বিলিয়ন পাউন্ড (৩৪ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ) কর বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে—
জুয়া খাতের ওপর অতিরিক্ত কর
উচ্চমূল্যের বাসভবনের ওপর বেশি কর

আয়করের সীমা ২০৩১ সাল পর্যন্ত স্থির থাকবে, ফলে সময়ের সাথে সাথে আরও বেশি মানুষ উচ্চ করের আওতায় আসবেন। এছাড়া ২০২৮ সালের এপ্রিল থেকে ২০ লাখ পাউন্ডের বেশি মূল্যের বাড়ির মালিকদের বার্ষিক ২,৫০০ থেকে ৭,৫০০ পাউন্ড পর্যন্ত অতিরিক্ত কর দিতে হবে। এটি প্রায় ১,৫৩,০০০ বাড়ির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে, যার ৮৮ শতাংশই লন্ডনে।
২০২৯ সাল থেকে ২,০০০ পাউন্ডের বেশি বেতন-ত্যাগভিত্তিক (স্যালারি স্যাক্রিফাইস) পেনশন অবদানের ওপর ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স আরোপ করা হবে। বাজেট দপ্তর (ওবিআর) অনুমান করছে, এতে প্রায় ৪.৭ বিলিয়ন পাউন্ড অতিরিক্ত রাজস্ব আসবে।
রিভস বলেন, এই পরিবর্তন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত কর্মীদের জন্য সুবিধাজনক হবে, কারণ তাঁদের করের পরিমাণ বাড়বে না।
জীবনযাপনের ব্যয় কমাতে কিছু সহায়তা

সরকার ঘোষণা করেছে, নির্দিষ্ট কিছু সবুজ শুল্ক কমানো হবে, যা গড়ে প্রতি পরিবারের বার্ষিক জ্বালানি বিল প্রায় ১৫০ পাউন্ড কমাতে পারে।
জ্বালানি কর অপরিবর্তিত থাকবে
রেলভাড়া বাড়বে না
প্রেসক্রিপশন চার্জও স্থির থাকবে দলীয় চাপের মুখে দুই-সন্তান নীতি সীমাও তুলে দেওয়া হবে
ন্যূনতম মজুরি ও রাষ্ট্রীয় পেনশন বৃদ্ধি—মুদ্রাস্ফীতির চেয়ে বেশি হারে
বাজারের প্রতিক্রিয়া
বাজেট ঘোষণার পর যুক্তরাজ্যের বন্ড ও পাউন্ডের দামে ওঠানামা দেখা যায়। আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবুরির বাজার কৌশলপ্রধান ম্যাথিউ রায়ান লিখেছেন, ‘‘এতে সরকারের ভবিষ্যতে আরও কর বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা কমতে পারে—তবে শর্ত হলো বাজার দেখতে চায় এই কঠোর আর্থিক শৃঙ্খলার সঙ্গে শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখা সম্ভব কি না।’’
# যুক্তরাজ্য বাজেট #পর্যটক_কর # লন্ডন ভ্রমণ #ইউএই_প্রবাসী #যুক্তরাজ্য_করনীতি
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















