দুর্নীতি ও সুশাসন নিয়ে আইএমএফের সর্বশেষ প্রতিবেদন স্বচ্ছতার ওপর বিশেষ জোর দিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই জটিল হলেও স্বচ্ছতা বাড়ালে কম প্রচেষ্টায় বেশি ফল পাওয়া সম্ভব। এই সহজলভ্য ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ দুর্নীতি রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
নিচে পুরো প্রতিবেদনের মূল বিষয়বস্তু সহজ ভাষায়, বিশ্লেষণধর্মী কাঠামোতে উপস্থাপন করা হলো।
স্বচ্ছতার গুরুত্ব
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকার ব্যবস্থার সব স্তরেই দুর্নীতি আছে, তবে সবচেয়ে ক্ষতিকর দুর্নীতি ঘটে সেইসব ‘সুবিধাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান’-এর মাধ্যমে, যারা রাষ্ট্রের মালিকানাধীন বা রাষ্ট্র-সম্পৃক্ত। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রভাব অর্থনীতির বড় খাতগুলোকে প্রভাবিত করে এবং নীতিনির্ধারণে অস্বচ্ছতা তৈরি করে।
আইএমএফ এখানে নাম উল্লেখ না করলেও উদাহরণ চোখে পড়ে। পুরনো সেই প্রবাদ অনুযায়ী—কাদের নাম বলা যায় না, তারাই প্রকৃত নিয়ন্ত্রক।
নির্দিষ্ট উদাহরণ: বোর্ড অব ইনভেস্টমেন্ট (বিওআই)
প্রতিবেদন যে অস্পষ্টতার কথা বলছে, তার একটি স্পষ্ট উদাহরণ হলো বিওআই। ২০২৩ সালে সংশোধিত আইনে প্রতিষ্ঠানটিকে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়—যাতে তারা নির্দিষ্ট প্রকল্পের জন্য নীতি-নিয়ম শিথিল বা অব্যাহতি দিতে এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দায়মুক্তি দিতে পারে।

আইনটির ১০ই, ১০এফ ও ১০জি ধারায় এসব ক্ষমতা উল্লেখ আছে।
আইএমএফের মন্তব্য অনুযায়ী, এসব ক্ষমতার ব্যবহার ও তদারকি সম্পর্কে স্পষ্ট তথ্য প্রকাশ জরুরি। কারণ এসব ধারার মাধ্যমে এমন একটি কাঠামো তৈরি হয়েছে, যা বিশেষ প্রকল্পগুলোকে অস্বাভাবিক সুবিধা দেয় এবং দায়মুক্তির সুযোগ সৃষ্টি করে।
নিয়ম শিথিলতার ঝুঁকি
নিয়ম ভেঙে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার সুযোগ তৈরি হলে তা সহজেই অপব্যবহারের পথে যেতে পারে।
সেরা নীতি: এ ধরনের ক্ষমতা না দেওয়াই উত্তম।
দ্বিতীয় সেরা: পরিষ্কার নিয়ম বেঁধে অপব্যবহার বন্ধ করা।
তৃতীয় সেরা: প্রতিবার এই ক্ষমতা ব্যবহারের তথ্য জনসমক্ষে বাধ্যতামূলকভাবে প্রকাশ করা।
আইএমএফের সুপারিশ হলো—দুই বছর পেরিয়ে গেলেও বিশেষ বিনিয়োগ সহজীকরণ কাউন্সিলের (এসআইএফসি) প্রথম বার্ষিক প্রতিবেদন এখনো প্রকাশ হয়নি। এটি অবিলম্বে প্রকাশ করা উচিত। প্রতিবেদনে থাকতে হবে:
• কোন কোন বিনিয়োগ অনুমোদিত হয়েছে
• কী ধরনের ছাড় দেওয়া হয়েছে (কর, নীতি, আইনগত বা বিধিনিষেধ শিথিল)
• এসব ছাড়ের কারণ ও আর্থিক মূল্য
• ১০এফ ধারা অনুযায়ী কোন নিয়ম কতবার শিথিল করা হয়েছে

বৃহত্তর স্বচ্ছতার দাবি
বিওআই যদি নিয়মিত তথ্য প্রকাশ শুরু করে, তাহলে একই ধরনের ক্ষমতা থাকা অন্যান্য সব সরকারি সংস্থার জন্যও এটি বাধ্যতামূলক করা উচিত। শুধু বার্ষিক প্রতিবেদন নয়, বরং রিয়েল-টাইম ডেটা প্রকাশের আইন করতে হবে। বিশেষ করে রাজস্ব বোর্ড (এফবিআর) ও বিদ্যুৎ বিভাগকে এতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
অদ্ভুতভাবে, দেশের বড় রাজস্ব সংকট বা চক্রাকারে বাড়তে থাকা বিদ্যুৎ ঋণ—কোনোটাই স্বচ্ছভাবে জনসমক্ষে প্রকাশের আইনগত বাধ্যবাধকতার আওতায় পড়ে না।
অস্বচ্ছতা ও ওভারল্যাপিং ক্ষমতার সমস্যা
যখন বহু সংস্থা অস্বচ্ছ ক্ষমতা নিয়ে কাজ করে, তখন তদারকির পুরো ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে।
প্রতিবেদনে যে তদারকি ব্যবস্থাগুলোর ক্ষতির কথা বলা হয়েছে:
• সংসদীয় নজরদারি
• নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা
• করপোরেট গভার্নেন্স
• আর্থিক প্রতিবেদন মান
• তথ্যপ্রকাশের বাধ্যবাধকতা
অস্বচ্ছতা, ক্ষমতার ওভারল্যাপিং, আর নির্বাচিতভাবে ছাড় দেওয়ার ফলে পুরো ব্যবস্থায় বিকৃতি তৈরি হয়।
পছন্দের সুবিধা বন্টন ও বাজার বিকৃতি
যখন নিয়ম ভাঙার ও বিশেষ সুবিধা নেওয়ার সুযোগ থাকে, তখন ব্যক্তি ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এই সুবিধা দখলে প্রতিযোগিতা শুরু করে। ফলাফল:
• বাজার বিকৃতি
• প্রতিযোগিতা কমে যাওয়া
• গোপন সমঝোতা
• সুযোগসন্ধানী ও প্রভাবশালী চক্রের উত্থান

এভাবে ধীরে ধীরে এমন পরিবেশ তৈরি হয় যেখানে যারা সত্যিকারের ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসা করতে চান, তারা বাদ পড়ে যায়। আর যারা সিস্টেমকে ব্যবহার করতে জানে, তারাই টিকে থাকে।
বিনিয়োগকারীদের বার্তা এবং প্রকৃত সংস্কার
যখন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কর কর্তৃপক্ষ বা বিচারব্যবস্থা থেকে সুরক্ষা চান, তখন তারা একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিচ্ছেন—দেশের প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশে আস্থাহীনতা রয়েছে।
খারাপ সমাধান: বিশেষ ছাড় দেওয়া
ভালো সমাধান: কর ব্যবস্থা ও বিচারব্যবস্থা সংস্কার করে সবার জন্য কার্যকর ও নিরপেক্ষ পরিবেশ তৈরি করা।
যখন সরকার প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা দূর না করে বিশেষ গোষ্ঠীর জন্য আইনের ঊর্ধ্বে থাকা সুবিধা তৈরি করে, তখন পুরো সিস্টেমের ওপর আস্থা আরও কমে যায়।
সরকারের সামনে করণীয়
সরকার এই নির্ণায়ক প্রতিবেদন তৈরি করেছে—এটি ইতিবাচক উদ্যোগ। তবে এর সত্যিকারের ফল পেতে হলে আইএমএফের সুপারিশগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে হবে।
#corruption #IMF #Pakistan #governance
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















