পাকিস্তানে নারীর প্রতি সহিংসতা ও বৈষম্য বহুদিনের বাস্তবতা। সেই অন্ধকারের মাঝেই নূর মুকাদ্দাম হত্যাকাণ্ড গভীর ধাক্কা দিয়েছিল পুরো দেশকে। চার বছরের আইনি লড়াই শেষে সুপ্রিম কোর্ট হত্যাকারী জাহির জাফরের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখলেও, ন্যায়বিচারের পথ এখনও দীর্ঘ—এমনই মনে করেন নূরের পরিবার ও অধিকারকর্মীরা। নূরের মৃত্যু শুধু একটি পরিবারের ট্র্যাজেডি নয়; এটি পাকিস্তানের প্রায় ১২ কোটি নারীর নিরাপত্তা, ন্যায্যতা এবং রাষ্ট্রীয় দায়িত্ববোধের এক কঠিন প্রশ্নকে সামনে আনে।
নূরের স্মৃতি: হাসিখুশি, মানবিক এক তরুণীর প্রতিচ্ছবি
শওকত আলী মুকাদ্দাম আজও মনে করতে পারেন মেয়ের নিষ্পাপ, উজ্জ্বল হাসি। চার বছর আগে মাত্র ২৭ বছর বয়সী নূরকে নির্মমভাবে হত্যা করে জাহির জাকির জাফর—পাকিস্তানের অত্যন্ত প্রভাবশালী একটি পরিবারের সদস্য। ঘটনার নিষ্ঠুরতা, তদন্ত, বিচার—সবকিছু মিলিয়ে এটি অনেকের ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় বিবেককে নাড়া দিয়েছে।
নূর ছিলেন শিল্পপ্রেমী, সামাজিক এবং মানবিক একজন মানুষ। আঁকাআঁকি, ক্যালিগ্রাফি, বয়স্ক মানুষের কাছে বসে সময় কাটানো কিংবা অনাথাশ্রমে জন্মদিন পালন—তার প্রতিটি কাজে ছিল মমতা ও সহমর্মিতার রঙ।
বিচারপ্রক্রিয়া: স্বস্তি ও হতাশার মিশ্র প্রতিক্রিয়া
২০২৫ সালের ২০ মে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট জাহির জাফরের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে। এর আগে সেশন কোর্ট ও হাইকোর্টও একই রায় দিয়েছিল। চার বছরের আইনি লড়াই পরিবারের জন্য ছিল মানসিক ও শারীরিকভাবে ক্লান্তিকর এক পথচলা।
তবে শওকত আলীর ক্ষোভ—নূরের চরিত্র হনন করার চেষ্টা হয়েছিল, যদিও ভিডিও ফুটেজে স্পষ্ট দেখা যায় নূর জীবন বাঁচাতে পালাচ্ছিল। তিনি মনে করেন বিচার দ্রুত হওয়া ইতিবাচক, কিন্তু হতাশ যে জাফরের বাবা-মা ও সহায়তাকারীরা খালাস পেয়েছেন।

তিনি স্পষ্ট করে বলেন, “এই দানবকে যত দ্রুত সম্ভব ফাঁসি দেওয়া হোক। সমস্ত কন্যার নিরাপত্তা এটার সঙ্গে জড়িত।”
এখন জাহির জাফরের সামনে কী অপেক্ষা করছে?
মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকায় জাফর রিভিউ আবেদন বা রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ পাবেন। তবে আইন বিশেষজ্ঞরা বলেন, রিভিউতে রায় বদলের সম্ভাবনা মাত্র ০.০১%।
২০১৭ সাল থেকে মানবাধিকার ও FATF–সম্পর্কিত চাপে পাকিস্তান বেশিরভাগ ক্ষমার আবেদন ঝুলিয়ে রেখেছে—শুধু কিছু জঘন্য মামলায় ব্যতিক্রম দেখা যায়।
পাকিস্তানে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা: সংখ্যার ভাষায় ভয়াবহ বাস্তবতা
পরিসংখ্যান বলছে, নারীর প্রতি সহিংসতা পাকিস্তানে কাঠামোগত ও বিস্তৃত এক সংকট।
• ২০২৩ সালে GBV–সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তি: ৩০,৬৩১
• বিচারাধীন: ৩৯,৬৫৫
• দণ্ড হার: অধিকাংশ অপরাধে ২%–এর নিচে

সম্মানহত্যা, গৃহ-সহিংসতা, ধর্ষণ—সব ক্ষেত্রেই সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু দণ্ডের হার অত্যন্ত কম।
ড. ফারজানা বারি বলেন, “নারীর প্রতি সহিংসতা কোনো বিচ্ছিন্ন সমস্যা নয়—এটি সামাজিক কাঠামোর গভীর বৈষম্যের ফল।”
আইনজীবী নিদা আলীর মন্তব্য, “নূরের মামলার রায়ে বিচারব্যবস্থা চাপের কাছে নত হয়নি। তবুও লিঙ্গসংবেদনশীল সংস্কার আরও জরুরি।”
নূরের মৃত্যুদিনের বার্তা: পরিবর্তন শুধু রায়ে নয়, সামাজিক মনোভাবেও
নূরের চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী মনে করিয়ে দেয়—এই ঘটনা কেবল একটি পরিবারকে নয়, পুরো পাকিস্তানকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। ন্যায্যতা, নিরাপত্তা এবং রাষ্ট্রীয় দায়িত্ববোধ নিশ্চিত করা ছাড়া নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
#সারাক্ষণ_রিপোর্ট #নূর_মুকাদ্দাম #ন্যায়বিচার #পাকিস্তান #নারীর_নিরাপত্তা #সহিংসতা #জাহির_জাফর
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















