চীনের নৃত্য, কোরিওগ্রাফি ও চলচ্চিত্র জগতের এক স্বতন্ত্র নাম ওয়েন হুই। ১৯৬০ সালে ইউনান প্রদেশে জন্ম নেওয়া এই শিল্পী সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ঠিক আগের সময়ে বড় হয়েছেন। ছোটবেলায় তিনি বিপ্লবী অপেরা দেখে নাচ শেখার চেষ্টা করতেন এবং রাস্তায় দাঁড়িয়ে মাও সে তুং–এর চিন্তাধারা ছড়িয়ে দিতে ‘লয়্যালটি ডান্স’ করতেন।
পরবর্তীতে তিনি রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত কঠোর প্রশিক্ষণের জন্য পরিচিত বেইজিং ডান্স অ্যাকাডেমিতে পড়েন। তবে ১৯৮০–এর দশকে সংস্কৃতিগত উন্মুক্ততার সময়ে তার শিল্পীজীবন অন্যদিকে মোড় নেয়। তিনি ধীরে ধীরে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বাইরে নিজের পথ তৈরি করেন—যেখানে শরীরের স্বাভাবিক বোধকে গুরুত্ব দিয়ে পারফরম্যান্স, ভিডিও, লেখা ও মৌখিক ইতিহাসকে একত্র করেন।
স্বাধীনতার পথে যাত্রা
১৯৯৪ সালে তিনি চলচ্চিত্র নির্মাতা উ ওয়েনগুয়াং–এর সঙ্গে ‘লিভিং ডান্স স্টুডিও’ প্রতিষ্ঠা করেন—চীনের প্রথম স্বাধীন নৃত্য থিয়েটার গ্রুপ। ২০০৪ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত বেইজিংয়ের উপকণ্ঠে ‘কাওচ্যাংদি ওয়ার্কস্টেশন’-এ তাদের স্টুডিও ছিল। সেখানে তিনি বার্ষিক উৎসব আয়োজন করতেন, তরুণ কোরিওগ্রাফারদের জন্য অনুশীলন ও পারফর্মের সুযোগ দিতেন এবং আন্তর্জাতিক বিনিময় কর্মসূচি চালাতেন।
বর্তমানে ৬৫ বছর বয়সী ওয়েন হুই ফ্রাঙ্কফুর্টে থাকেন। তবে নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিন অ্যাকাডেমি অব মিউজিকে তার নতুন কাজ ‘হোয়াট ইজ ওয়ার’ মঞ্চস্থ করার সময় ব্রুকলিনের একটি হোটেল থেকে তিনি নিজের শৈশব, স্বাধীন নৃত্যের বিকাশ, এবং কিভাবে তিনি নিজেকে নারীবাদী শিল্পী হিসেবে উপলব্ধি করেছেন—এসব নিয়ে কথা বলেন।

নিউ ইয়র্ক অভিজ্ঞতা: শিল্পী-দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন
তার প্রথম বিদেশ যাত্রা ছিল ১৯৯৪ সালে নিউ ইয়র্ক—যা তার চিন্তার জগতে বড় ধাক্কা আনে। তিনি বলেন,
নিউ ইয়র্কে এসে দেখলাম, নাচের জন্য মঞ্চ বা আলো লাগবেই—এটা বাধ্যতামূলক নয়। রাস্তায়, ট্রেনে—যেকোনো জায়গায় নাচ করা যায়। স্বাধীনভাবে সৃষ্টির এই ধারণা আমার মাথায় বড় পরিবর্তন আনল।
তখন চীনে স্বাধীন নৃত্য দল ছিল না; শুধুই সরকারি দল, যেখানে ব্যক্তিগত চিন্তার কোনো জায়গা ছিল না। ৮০ ও ৯০–এর দশকে শিল্প ছিল মূলত ‘বৃহৎ বয়ান’-এর ওপর ভিত্তি করে, ব্যক্তিগত অভিব্যক্তির নয়।
লিভিং ডান্স স্টুডিও: বাস্তবতার ভাষায় শিল্প
স্টুডিও প্রতিষ্ঠার মূল দর্শন ছিল—
‘১০০ শতাংশ জীবন, ০ শতাংশ শিল্প।’
অর্থাৎ শিল্প হবে জীবনের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন, কেবল শিল্প তৈরির জন্য শিল্প নয়।

তার প্রথম স্বাধীন কাজ ছিল ‘১০০ ভার্বস’ (১৯৯৪)। এক নারীর দৈনন্দিন জীবনের ১০০টি ক্রিয়াকে মঞ্চে উপস্থাপন করা হয়। তিনি মেঝে পরিষ্কার করেন, কাপড় ধোয়, বারবার ধোয়, গোসল করেন, কাপড় ঝোলান—সবই নৃত্যভঙ্গির সঙ্গে মিলিয়ে।
৮০ ও ৯০–এর দশকে চীনা নারীরা সামাজিক ও পারিবারিক দায়বদ্ধতার প্রবল চাপের মধ্যে ছিলেন, কিন্তু প্রকাশের ভাষা জানতেন না। ওয়েন হুই মনে করতেন—এই প্রকাশ দরকার। স্বাধীন নৃত্যশিল্পী না থাকায় তিনি বন্ধুদের নিয়ে পারফরম্যান্স সাজান। অনেকেই সমালোচনা করেন—‘এটা নাচ নয়।’ কিন্তু তিনি থেমে থাকেননি।
নারীর অভিজ্ঞতা: ব্যক্তিগত ভাষার সন্ধান
১৯৯৯ সালের ‘রিপোর্ট অন গিভিং বার্থ’ নারীর অভিজ্ঞতাকে আরও গভীরভাবে তুলে ধরে।
এই কাজের অনুপ্রেরণা আসে নানা বয়স, পেশা ও প্রেক্ষাপটের নারীদের সাক্ষাৎকার থেকে—ট্যাক্সি চালক, শ্রমিক, বিভিন্ন প্রজন্মের নারী।
৬০, ৭০ ও ৮০–এর দশকে নারীরা এক ধরনের সামষ্টিক ভাষায় কথা বলতেন। কিন্তু গর্ভধারণ ও সন্তান জন্মদানের অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলতে গেলে তাঁদের ভাষা হঠাৎ ব্যক্তিগত ও আন্তরিক হয়ে ওঠে।
ওয়েন হুই উপলব্ধি করেন—জন্ম দেওয়ার অভিজ্ঞতা নারীদের প্রকাশের একটি স্বাভাবিক দ্বার। পাঁচ বছর সাক্ষাৎকার নেওয়ার পর তিনি এটি মঞ্চে রূপ দেন।

সৃজনশীলতা ও বয়স
যৌবনে তিনি ভয় পেতেন—কাজ সঠিক হচ্ছে কি না, তা বুঝতেন না। ‘১০০ ভার্বস’–এর সময় তিনি সম্পূর্ণভাবে অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে কাজ করেছিলেন। পরে সমালোচকরা একে নারীবাদী কাজ বলেন—যদিও তখন তিনি নিজে তা বোঝেননি।
এখন তিনি আরও স্বচ্ছ, আত্মবিশ্বাসী এবং স্পষ্ট জানেন—কোন বিষয় নিয়ে কথা বলা জরুরি।
নতুন প্রজন্মের চ্যালেঞ্জ
আজকের তরুণ চীনা কোরিওগ্রাফারদের জন্য সুযোগ আছে—বিশেষ করে সাংহাইয়ে। কিন্তু অনেক সুযোগই ফ্যাশন ও অর্থকেন্দ্রিক। গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে গেলে নানা সীমাবদ্ধতা আসে—ফান্ডিং থাকলেও বলা হয়, ‘এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না।’
ওয়েন হুই মনে করেন—
যদি শিল্পীরা নিজস্ব চিন্তা প্রকাশ করতে না পারেন, স্বাধীন শিল্পচর্চা টিকে থাকবে কীভাবে? এটি আজকের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
ওয়েন হুইয়ের যাত্রা দেখায়—শরীর, অভিজ্ঞতা ও ব্যক্তিগত ভাষা দিয়ে শিল্প কীভাবে সমাজকে অন্যভাবে দেখাতে পারে। তার কাজ নারীদের জীবন, বাস্তবতা এবং ব্যক্তিগত অনুভূতিকে কেন্দ্র করে চীনের সমকালীন নৃত্যকে নতুন পথ দেখিয়েছে।
#wenhui #chinadance #contemporaryart #feministart #performanceart #dancehistory #banglareport
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















