হংকংয়ে প্রকাশনা স্বাধীনতার ক্ষেত্র সংকুচিত হওয়ার ধারণা থেকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক লেখক ও প্রকাশক তাইওয়ানে পাড়ি জমাচ্ছেন। ২০২০ সালে বেইজিংয়ে আরোপ করা জাতীয় নিরাপত্তা আইন প্রকাশনা, বিক্রি বা মন্তব্য প্রকাশের ক্ষেত্রে নতুন ঝুঁকি তৈরি করেছে। এর প্রভাব পড়ছে লেখকদের আত্মবিশ্বাস, প্রকাশনার পরিবেশ এবং সৃজনশীলতার পরিসরে।
হংকংয়ের স্বাধীনতা সংকুচিত হওয়ার অভিযোগ
জাতীয় নিরাপত্তা আইন কার্যকর হওয়ার পর থেকেই হংকংয়ের লাইব্রেরি ও বইয়ের দোকানগুলো শতাধিক বই তুলে নিয়েছে, বিশেষ করে রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল বা ইতিহাসভিত্তিক বই—যেমন ১৯৮৯ তিয়ানআনমেন স্কোয়ারের ঘটনার ওপর লেখা।
বই বিক্রেতারা রাজনৈতিক ঝুঁকি এড়াতে অনেক বই রাখতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন। হংকংয়ের বাউন্ডারি বুক স্টোরের মালিক লিয়ান লিউ জানান, জিমি লাইকে নিয়ে লেখা বইসহ সমাজ–রাজনীতি বিষয়ক সরাসরি মন্তব্যযুক্ত বই দোকান থেকে সরাতে হয়েছে।
২০২৫ সালে হংকং বুক ফেয়ার থেকে বেশ কয়েকটি প্রকাশককে কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই বাদ দেওয়া হয় এবং অনেককে নির্দিষ্ট শিরোনাম তুলে ফেলতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
ব্লুস্কাই পাবলিশিংয়ের সম্পাদক-ইন-চিফ লেসলি এনজি জানান, এখন প্রকাশকদের প্রতিটি শব্দ ও বাক্য যাচাই করতে হয়, কারণ কখন কোন লাইনকে জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে ধরা হবে—তা কেউ জানে না।

তাইওয়ানে লেখকদের নতুন ঠিকানা
এই অনিশ্চয়তার মধ্যেই বহু হংকং লেখক সৃজনশীল স্বাধীনতার সন্ধানে তাইওয়ানে চলে যাচ্ছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম গিগি লিয়াং, যিনি চার বছর ধরে তাইপেতে বসবাস করছেন।
নিজের জন্মভূমির স্বাদ–গন্ধের অভাব যদিও অনুভব করেন, কিন্তু লেখালেখির স্বাধীনতা তাকে তাইওয়ানের প্রতি টেনে রাখছে।
তার ২০২২ সালের উপন্যাস ‘এভরিডে মুভমেন্ট’—যা ২০১৯ সালের হংকং আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া দুই নারীর গল্প—হংকংয়ের এক প্রকাশক প্রকাশে আগ্রহ দেখালেও শর্ত দিয়েছিল ব্যাপক সম্পাদনা করার।
কিন্তু তাইওয়ানের সম্পাদক তাকে জানিয়েছেন, ‘সংবেদনশীল’ বলতে কী বোঝায়, তা তিনি বুঝতে পারেন না—এবং তাইওয়ানে প্রকাশযোগ্য বিষয়ের কোনো নিষিদ্ধ তালিকায় নেই।
এই বিপরীত অভিজ্ঞতাই লেখককে বুঝিয়েছে যে তার কাজ হংকংয়ে নানা সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হবে।
তাঁর বইটি ২০২৪ সালের হংকং বুক ফেয়ার শেলফ থেকেও আইনি পরামর্শের ভিত্তিতে সরিয়ে দেওয়া হয়। লেখক বলেন, এ কারণেই তিনি তাইওয়ানে থেকে লিখতে বাধ্য হয়েছেন।

লেখক মুকিউ-এর অভিজ্ঞতা
লেখক মুকিউ—আসল নাম ফুং বাক কুই—বলছেন, হংকংয়ে প্রকাশনার ক্ষেত্রে কী ছাপা যাবে আর কী যাবে না, সেটি নিয়ে ‘গেসওয়ার্ক’ চলে। সরাসরি রাজনৈতিক বিষয় নিষিদ্ধ হওয়া নিশ্চিত, কিন্তু সীমারেখার কাছাকাছি থাকা লেখা নিয়ে উদ্বেগ বেশি।
হংকং থেকে তাইওয়ানে পাল্টে যাওয়া শিল্প পরিবেশ
২০১৯ সালের বৃহৎ গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনের পর সমাজ বিভক্ত হয়ে পড়ে, এবং এর পরই বহু মানুষ হংকং ছেড়ে অন্য দেশে চলে যান। ২০২০ সাল থেকে প্রায় ৬ লাখ মানুষ হংকং ছেড়েছেন।
মুকিউর লেখায় প্রবাসী হংকং বাসীর অভিজ্ঞতা জোরালোভাবে উঠে আসে। তাঁর নতুন বই ‘জেনারেশন্স’—যা আট প্রজন্মের হংকংবাসীর তাইওয়ান জীবনের গল্প—২০২৬ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত হবে।

তাইওয়ানের স্প্রিং হিল পাবলিশিং ইতোমধ্যে আইন, দর্শন, সিনেমা—বিভিন্ন ক্ষেত্র নিয়ে হংকংকে কেন্দ্র করে আটটি বই প্রকাশ করেছে।
স্প্রিং হিল সম্পাদক-ইন-চিফ জুয়াং জুই-লিন বলেন, হংকংয়ে সৃজনশীলতার ক্ষেত্র কমার সঙ্গে সঙ্গে তাইওয়ানের প্রকাশকেরা ভাবতে শুরু করেছেন কীভাবে হংকংয়ের গল্প তুলে ধরা যায়।
তাইওয়ানে নতুন সুযোগ—তবু সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে
তাইওয়ানে প্রকাশনা করা হংকং লেখকদের জন্য একটি সম্ভাবনা তৈরি করেছে, তবে এটি সবার জন্য সহজ নয়।
লেসলি এনজি বলেন, অনেক লেখকের বাইরে চলে যাওয়ার সামর্থ্য নেই। হংকংয়ে থেকেই বই প্রকাশের চেষ্টা করলে তারা নিরাপদ থাকবেন—এমন নিশ্চয়তা নেই। লেখক ও প্রকাশক দুজনেই যদি হংকংয়ে থাকেন, তাহলে আইনগত ঝুঁকি থেকেই যায়।
সমাপনী মন্তব্য
হংকংয়ের সঙ্কুচিত স্বাধীনতার পরিবেশ বহু লেখককে সৃজনশীলতার আশ্রয় হিসেবে তাইওয়ানের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
তারা মুক্তভাবে গল্প বলতে চান—যা হংকংয়ে দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে।
তাইওয়ান এখন হংকং সাহিত্যিকদের জন্য নতুন এক নিরাপদ জায়গা, যেখানে তাদের কণ্ঠ দমিয়ে দেওয়ার ভয় নেই।
#হংকং #তাইওয়ান #প্রকাশনা_স্বাধীনতা #সৃজনশীলতা #লেখক #জাতীয়_নিরাপত্তা #বুকফেয়ার #প্রবাস #সাহিত্য #সারাক্ষণ_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















