দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার ছোট্ট শহর অল্টাডিনা একসময় শান্ত, প্রায় পোস্টকার্ডের মতো ছিল। স্কুলের আঙিনায় খোলা আকাশ, দূরে পাহাড়ের রেখা, আর ছুটোছুটি করা বাচ্চারা। এখন সেখানে আছে ধুলোর মাঠ, ভাঙা চিমনি, কোথাও থেকে কোথাও না-যাওয়া সিঁড়ি। এই এক টুকরো দৃশ্যই বলে দেয়, লস অ্যাঞ্জেলেসের আগুন শহরটাকে কত গভীরে বদলে দিয়েছে।
আগাম সংকেত ছিল, প্রস্তুতি ছিল না
দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় বনআগুন নতুন কিছু নয়। কয়েক বছরের অদ্ভুত বৃষ্টি–খরার দোলাচলে ঝোপঝাড় শুকিয়ে জ্বালানি হয়ে ছিল, জানুয়ারির স্বাভাবিক তীব্র হাওয়াও ছিল—এক কথায়, বিপর্যয়ের সব উপকরণ প্রস্তুত ছিল আগেই। কিন্তু আগুন লাগার রাতে দেখা গেল, যাদের দায়িত্ব ছিল মানুষ বাঁচানো, তাদের নিজের বাস্তবতা অন্যরকম।
হাইড্রান্টে পর্যাপ্ত পানি নেই। অনেক দমকলকর্মী দৌড়াচ্ছেন পুরোনো ও অসম্পূর্ণ তথ্য নিয়ে। একেক মহল্লায় সতর্কবার্তা এসেছে তখন, যখন ঘরে ইতিমধ্যে আগুন ধরে গেছে।

অল্টাডিনার এক পাশে তুলনামূলক আগে এলার্ট গেছে। আরেক পাশে, যেখানে বহু কৃষ্ণাঙ্গ ও লাতিনো পরিবার কয়েক দশক ধরে ঘর বানিয়ে উঠেছিল, সেখানকার মানুষ ঘুমিয়ে ছিলেন সম্পূর্ণ অজ্ঞাত থেকে। রাত সাড়ে তিনটায় আনুষ্ঠানিক বার্তা পৌঁছায়। ততক্ষণে অনেক ঘরের ছাদে আগুন। প্রতিবেশীরা একে অন্যের দরজায় ধাক্কা মেরে মানুষ জাগিয়েছেন। ওই রাতেই উনিশজন মারা যান, প্রায় সবাই সেই পশ্চিম প্রান্ত থেকে।
সেই রাতের ধোঁয়া অনেকের ফুসফুস থেকে সরে গেছে, কিন্তু ভয় আর অবিশ্বাস রয়ে গেছে ভেতরে। লস অ্যাঞ্জেলেসের আগুন শুধু গাছ আর বাড়ি পোড়ায়নি, মানুষ আর রাষ্ট্রের মধ্যে আস্থার সেতুটাও ঝলসে ফেলেছে।
দুর্যোগের পর আরেক দুর্যোগ: অদৃশ্য নেতৃত্বের শূন্যতা
আগুন নেভার পর শুরু হয়েছে আরেক ধরনের সংকট। কে দায় নেবে, কে টাকা দেবে, কে সিদ্ধান্ত নেবে—এই তর্কেই সময় কেটে যাচ্ছে। রাজ্য সরকার বলছে, আগের মতো ফেডারেল অর্থ আসুক। ফেডারেল সরকার বলছে, ক্যালিফোর্নিয়াকেই আগে দায়িত্ব নিতে হবে।
এর মাঝখানে আটকে আছে স্কুল, ছোট ব্যবসা, আর বাড়ি-হারা পরিবার। কেউ দাবি তুলছে, অল্টাডিনাকে স্বাধীন শহর বানাতে হবে, যাতে স্থানীয়রাই সব সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কেউ মাটি আর বাতাসে বিষাক্ততার পরীক্ষা বাড়ানোর কথা বলছেন। কেউ লড়ছেন বীমা কোম্পানির বিরুদ্ধে, যেন অন্তত চুক্তি অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায়।
কাগজে-কলমে বড় সাহায্যের অংক বলা হলেও বাস্তবে পুনর্গঠন এগোচ্ছে ধীরে। বিনিয়োগ ফান্ড আর প্রাইভেট ব্যাংক দেখছে—লস অ্যাঞ্জেলেসের আগুন–পরবর্তী পুনর্গঠনে কোথায় লাভের সুযোগ, কোথায় ঝুঁকি। অনেক জমি ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে দূরের বিনিয়োগকারীর হাতে। অনেকের জন্য প্রশ্নটা একেবারেই ব্যক্তিগত—আমি আদৌ ফিরতে পারব তো আমার পুরোনো পাড়ায়?
দুপুরের টিভি টকশোতে বা দূরের দেশের খবরে এই আগুনকে সহজ ফ্রেমে সাজানো হয়—প্যালিসেডসে ধনী সেলিব্রিটি, অল্টাডিনায় সংগ্রামী মধ্যবিত্ত কৃষ্ণাঙ্গ ও লাতিনো পরিবার। এই বিভাজনের ভেতরে একটা বড় সত্য চাপা পড়ে যায়: জলবায়ু দুর্যোগ আর লস অ্যাঞ্জেলেসের আগুন শেষ পর্যন্ত সবার সামনে একই প্রশ্ন রাখে—ভাবছো তুমি নিরাপদ, সত্যি কি তাই?
এই আগুন কেবল কয়েকটি পুড়ে যাওয়া বাড়ির গল্প না। এটা এক ধরনের ট্রায়াল রানের মতো—দেখিয়ে দিচ্ছে, উষ্ণ হয়ে ওঠা এই গ্রহে আমাদের রাজনৈতিক কাঠামো, অর্থনীতি আর সামাজিক বন্ধন কতটা অপ্রস্তুত, কতটা ভঙ্গুর। হয়তো কয়েক বছর পর কেউ দাঁড়িয়ে বলবে, এখানে একসময় একটানা পাড়া ছিল, এখন শুধু ফাঁকা প্লট আর উল্টো করে বাঁধা পতাকা। তখন নতুন করে শেখার সময় হয়তো থাকবে, কিন্তু সেই শেখার দাম হবে অনেক বেশি।

সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















