সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চ্যাটবটসহ নানা ধরনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) সরঞ্জাম এখন পাঠদানের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে উঠছে। শিক্ষার্থীরা এই প্রযুক্তির সাহায্যে শেখার দক্ষতা বাড়াচ্ছে, তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া পাচ্ছে এবং নিজেদের সুবিধামতো শিক্ষাপদ্ধতি সাজিয়ে নিচ্ছে।
শিক্ষার্থীরা দ্য স্ট্রেইটস টাইমসকে জানিয়েছে, এআই শেখার প্রক্রিয়াকে কখনও অতিরিক্ত সহজ করে দিতে পারে, তবে তারা নিজেদের কাজ পরীক্ষা করে এবং মূল চিন্তাভাবনা নিজেরাই করে থাকে।
ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের (এনইউএস) আইন বিভাগের শিক্ষার্থী সিরিন চিয়ং বলেন, “এআই ব্যবহারে শিক্ষার্থীরা অলস হওয়ার ঝুঁকি থাকে। কিন্তু সঠিকভাবে ব্যবহার করলে শিখনপ্রক্রিয়া দ্রুত হয়।”
নানইয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটির (এনটিইউ) অ্যানাটমি বিভাগের সিনিয়র লেকচারার ড. রঙ্গনাথ বল্লভজোস্যুলা জানান, এআই ব্যবহারের ভারসাম্য রক্ষা করা বেশ কঠিন। তাঁর মতে, সাধারণ ধারণা শেখায় এআই ব্যবহার করা যেতে পারে, তারপর ধীরে ধীরে উন্নত ধারণাগুলো নিজেরা শিখে নেওয়া উচিত।
তিনি আরও বলেন, এআই এমনভাবে ব্যবহার করা জরুরি, যেন তা সমালোচনামূলক চিন্তার বিকল্প নয়, বরং সহায়ক হয়।
আদালতের জেরা অনুশীলনে চ্যাটবট
এনইউএসে আইন শিক্ষার্থীরা ট্রায়াল অ্যাডভোকেসি কোর্সে জেরা অনুশীলনের জন্য একটি চ্যাটবট ব্যবহার করছে। মার্চে চালু হওয়া এই বট নানা পরিস্থিতি তৈরি করে—কখনও ভীত-সন্ত্রস্ত বা এড়িয়ে যাওয়া সাক্ষী, কখনও কঠোর বিচারক—যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন করা ও আদালতের শিষ্টাচার চর্চা করতে পারে।
তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ইমানুয়েল ওয়ং (২৩) ও সিরিন চিয়ং (২১) জানান, এই বট তাদের সঠিক পথে রাখে। ইমানুয়েল বলেন, বটের “বিচারক” ভুল প্রশ্ন করলে তাৎক্ষণিক আপত্তি জানায়—যা সহপাঠীরা অনেক সময় ধরতে পারে না।
চিয়ং বলেন, নিজের গতিতে অনুশীলন করার সুযোগ থাকায় মানসিক চাপ কমে।
বটের সাহায্যে তারা সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন করতে শেখে এবং কঠিন সাক্ষী বা অযৌক্তিক আপত্তি সামলানোর অভিজ্ঞতা পায়।
সহযোগী অধ্যাপক মার্ভিন চিয়ং জানান, বাস্তব কেসের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনি এই বটের জন্য বিভিন্ন পরিস্থিতি ও তথ্য সাজিয়েছেন। এখন পর্যন্ত ১২৬ জন শিক্ষার্থী এই টুল ব্যবহার করেছে।
তিনি বলেন, “সরাসরি অনুশীলনে গেলে অনেকের সামনে কাজ করতে হয়, তখন উদ্বেগ দূর করা কঠিন। নিজের জায়গায় অনুশীলন করলে চিন্তা করার সময় পাওয়া যায়।”

ডিজাইন থিংকিং বট: ভার্চুয়াল অংশীদার
সিঙ্গাপুর ম্যানেজমেন্ট ইউনিভার্সিটিতে (এসএমইউ) শিক্ষার্থীরা ডিজাইন থিংকিং পাঠে এক ধরনের “স্টেকহোল্ডার বট” ব্যবহার করে। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে চালু হওয়া এ বট স্কুল অব কম্পিউটিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমসের প্রায় ৪০০ শিক্ষার্থী ব্যবহার করেছে।
চতুর্থ বর্ষের কম্পিউটিং শিক্ষার্থী অং সুই লং (২৫) জানান, ক্যাম্পাসে খাদ্য অপচয় কমানোর প্রকল্পে এআই তাকে প্রযুক্তিনির্ভর সমাধান থেকে সরে এসে বাস্তবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিতে সাহায্য করে।
বটের মাধ্যমে ছাত্র, প্রোভোস্ট, খাবার বিক্রেতা ও কর্মচারীদের দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনায় নিতে শেখে তারা। এমনকি বটের প্ররোচনায় তাদের দল বাস্তবে একটি কুফু ক্লিনারকে সাক্ষাৎকারও নেয়, যা টেক-ভিত্তিক সমাধানের বাইরে বাস্তব বাধা-সমস্যা বুঝতে সাহায্য করে।
বট বিভিন্ন প্রশ্ন, সমস্যা বিবৃতি, প্রোটোটাইপের ধারণা পর্যন্ত জোগায়।
সিনিয়র লেকচারার কিরুথিকা রমনাথন জানান, এই টুলের উদ্দেশ্য কম্পিউটার বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত সমাধানে সীমাবদ্ধ না রেখে মানুষের প্রয়োজনকেও বিবেচনায় আনতে শেখানো।
বটের সহায়তায় শিক্ষার্থীরা একক কেন্দ্রীভূত পুশকার্ট তৈরি করে—যা ওজন মাপার যন্ত্র, ক্যামেরা ও বিভিন্ন বালতি নিয়ে গঠিত—এবং ১৬টি আলাদা কার্টের কাজ এক জায়গায় নিয়ে আসে।
ব্যক্তিগত শিক্ষক হিসেবে এআই
সিঙ্গাপুর ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি অ্যান্ড ডিজাইন (এসইউটিডি)-এর শিক্ষার্থীরা নিজেদের শেখার ধরন অনুযায়ী বট তৈরি করছে।
ইঞ্জিনিয়ারিং প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী অনিয়েরুধ আর. গণিত পরীক্ষার আগের দিন নিজের অধ্যাপক বার্নার্ড ই-র শিক্ষণশৈলী অনুকরণ করে “জিপিটি বার্নি” তৈরি করেন।
তিনি বলেন, “কয়েক মিনিটেই মনে হয় যেন আমি তাঁর অফিসে বসে আছি।”
এর ফলে তাঁর অধ্যাপককে পাঠানো ই-মেইল ৭০ শতাংশ কমে যায়।
এই বট সাধারণ প্রশ্নগুলো সমাধান করে দেয়, ফলে সরাসরি সাক্ষাতে গভীর আলোচনার সুযোগ তৈরি হয়।
অনিয়েরুধ জানিয়েছেন, তিনি এখন দল নিয়ে আরও বট তৈরি করছেন, যা মিলিয়ে “জিপিটি প্রফস” নামে একটি লাইব্রেরি গড়ে উঠছে—যা প্রশাসনিক কাজ, প্রকল্প নকশা এবং শিক্ষণ সহায়তায় ব্যবহৃত হচ্ছে।
এনটিইউর লি কং চিয়ান স্কুল অব মেডিসিনে Anatbuddy নামে একটি অ্যানাটমি চ্যাটবট ২০২৪ সালের নভেম্বর থেকে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি শিক্ষার্থীদের শুধু অঙ্গের নাম নয়, বরং “যদি এমন হতো?” ধরনের ক্লিনিকাল প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে প্ররোচিত করে।
ড. রঙ্গনাথ জানান, এতে শিক্ষার্থীরা আরও গভীরভাবে যুক্ত হয় এবং ধারণা শক্তিশালী হয়।
এতে শ্রেণিতে এসে তারা আরও প্রস্তুত থাকে এবং অর্থবহ প্রশ্ন করতে পারে।
সিঙ্গাপুর ইউনিভার্সিটি অব সোশ্যাল সায়েন্সেসের শিক্ষার্থীরা iSmartGuide নামে একটি বুদ্ধিমান সহচর ব্যবহার করছে; এটি ক্ষুদ্র পাঠ, ফ্ল্যাশকার্ড ও কুইজ দেয়।
২০২৫ সালের জুনে চালুর পর থেকে এটি ২২ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী ব্যবহার করেছে।
সিঙ্গাপুর ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এসআইটি) ClassAId প্ল্যাটফর্মে শিক্ষকরা বিভিন্ন বিষয়ের জন্য কাস্টম বট তৈরি করতে পারেন।
CommunicAId নামে আরেকটি প্ল্যাটফর্ম শিক্ষার্থীদের পেশাগত যোগাযোগ অনুশীলন, কঠিন আলোচনায় দিকনির্দেশনা এবং তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেয়।
গবেষণায় এআই-এর ব্যবহার
এআই গবেষণায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
এনটিইউর মেডিকেল শিক্ষার্থীরা ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে RileyBot ব্যবহার করছে, যা বিভিন্ন ডেটাবেস থেকে তথ্য সংগ্রহে সাহায্য করে।
মেডিকেল লাইব্রেরিয়ান রেবেকা ডেভিড জানান, প্রতিটি ডেটাবেসের আলাদা ইন্টারফেস থাকায় শিক্ষার্থীরা বিভ্রান্ত হয়। RileyBot যথাযথভাবে অনুসন্ধান নির্দেশনা দেয় এবং সাধারণ চ্যাটবটের চেয়ে বেশি নির্ভুল।
৫০০-র বেশি শিক্ষার্থী এখন পর্যন্ত RileyBot ও Anatbuddy ব্যবহার করেছে।
ড. রঙ্গনাথ বলেন, “প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিজ্ঞান—এই দুই ক্ষেত্রকে শিক্ষাজীবনে মিলিয়ে দিলে শিক্ষার্থীরা শেখার ওপর আরও আত্মবিশ্বাস ও নিয়ন্ত্রণ পায়।”
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















