লম্বা ছাড় মৌসুমে ক্রেতার নতুন মানসিক চাপ
একসময় সাইবার মানডে মানে ছিল এক দিনের অনলাইন উৎসব; এখন সেটি যেন সপ্তাহজুড়ে চলা এক প্রচারাভিযান। ২০২৫ সালে বড় বড় ই–কমার্স প্ল্যাটফর্ম, গ্যাজেট ব্র্যান্ড আর স্ট্রিমিং সার্ভিসগুলো আনুষ্ঠানিক দিন শেষ হওয়ার পরও অফার চালিয়ে যাচ্ছে। ল্যাপটপ, হেডফোন, গেমিং কনসোল, স্মার্ট–হোম ডিভাইস—সব জায়গাতেই ব্যানারে দেখা যাচ্ছে “৭০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড়” কিংবা “সেরা দাম এই সপ্তাহেই।” অনেক জনপ্রিয় পণ্যের দাম এখনো বছরের সর্বনিম্ন সীমার কাছাকাছি ঘোরাফেরা করছে। ফলে একদিনের বদলে ক্রেতারা দিন কয়েক ধরে “শেষ সুযোগ” বার্তার ভিড়ে বন্দি হয়ে যাচ্ছেন।
টেক রিভিউ সাইটগুলো দেখাচ্ছে, যেসব অফারকে সাইবার মানডের মূল আকর্ষণ বলা হয়েছিল, সেগুলোর বেশ কয়েকটি আসলে পরের দিনও অদৃশ্য হয়নি। জনপ্রিয় ওয়্যারলেস ইয়ারবাড বা নয়েজ–ক্যানসেলিং হেডফোন এখনো বহু দোকানে কমদামে মিলছে, গেমিং কনসোলের সঙ্গে অতিরিক্ত কন্ট্রোলার বা ডিজিটাল গেম বোনাস হিসেবে দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলো কয়েক মাসের ডিসকাউন্ট সাবস্ক্রিপশন চালু রেখে নতুন গ্রাহক টানার চেষ্টা করছে—প্রথম কয়েক মাস খুব কম টাকা, তারপর স্বাভাবিক বা বেশি মাসিক ফি। বিশ্লেষকদের ধারণা, বছরজুড়ে চাহিদা সমানভাবে ছড়িয়ে দিতে এবং ব্যবহারকারীকে নিজস্ব ইকোসিস্টেমে দীর্ঘদিন আটকে রাখতে এই কৌশল কাজে আসছে।
ধারাবাহিক অফারের সুফল আর ফাঁদ
ভোক্তার জন্য এই দীর্ঘায়িত সেলস সিজনের ভালো দিকও আছে। যাদের পক্ষে মূল দিনে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়নি, তারা এখন একটু সময় নিয়ে রিভিউ পড়তে, দাম তুলনা করতে বা ওয়ারেন্টি–শর্ত বুঝে নিতে পারছেন। বড় অঙ্কের কেনাকাটার ক্ষেত্রে—যেমন মনিটর, ল্যাপটপ বা প্রিমিয়াম স্পিকার—এই বাড়তি সময় কখনো কখনো অপচয় ঠেকাতে সাহায্য করে। কেউ চাইলে কয়েক দিন ধরে দাম পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারেন, যে অফারটাকে “ডোরবাস্টার” বলা হচ্ছে, তা আসলেই নতুন কিছু কি না, নাকি আগের প্রচারণারই পুনরাবৃত্তি।
কিন্তু একই সঙ্গে বাড়ছে অপ্রয়োজনীয় খরচের ঝুঁকিও। মোবাইল আর ব্রাউজারে বারবার পপ–আপ, ইমেইলে “আর কয়েক ঘণ্টা বাকি” লেখা সাবজেক্ট—সব মিলিয়ে মানুষের মনে একটি চাপ তৈরি হয়, যেন আজ অর্ডার না করলে আর কখনো পাওয়া যাবে না। অনেক দোকান আবার “মূল দাম” হিসেবে এমন অঙ্ক দেখায়, যেখানে পণ্যটি বাস্তবে কখনোই সেই দামে বিক্রি হয়নি; কেবল ছাড়কে নাটকীয় করে দেখানোর জন্যই সেই কৌশল। সচেতন ভোক্তাদের তাই বলা হচ্ছে, আগে থেকে বাজেট ঠিক করে রাখা, প্রয়োজনের তালিকা বানিয়ে নেওয়া, আর কিছু সময় স্ক্রিন থেকে দূরে থাকাও জরুরি।
![]()
সাবস্ক্রিপশন আর লুকানো খরচের খেলায়
হার্ডওয়্যারের ছাড়ের পাশাপাশি সাবস্ক্রিপশন–ভিত্তিক সেবাগুলোও এই দীর্ঘ সেলস উইন্ডোকে কাজে লাগাচ্ছে। সস্তা ট্রায়াল পিরিয়ড দিয়ে তারা চায়, নতুন ডিভাইস কেনার সঙ্গে সঙ্গে গ্রাহক যেন কোনও না কোনও স্ট্রিমিং, ক্লাউড স্টোরেজ বা অনলাইন কোর্সে সাইন আপ করে ফেলেন। প্রচারণায় ভেসে আসে “যেকোনো সময় বাতিলযোগ্য” বা “চুক্তি ছাড়া”—কিন্তু বাস্তবে অনেকেই সময়মতো সাবস্ক্রিপশন বন্ধ করতে ভুলে গিয়ে পূর্ণ মূল্যে টাকা দিতে শুরু করেন। কয়েক মাস পরে হিসাব কষতে গিয়ে তখন দেখা যায়, সস্তা ট্রায়াল আসলে দীর্ঘমেয়াদি ব্যয়ে পরিণত হয়েছে।
ডেলিভারি আর লজিস্টিকসও এই নতুন ছন্দের অংশ। সরবরাহ চেইন একসঙ্গে কয়েক দিনের অর্ডার সামলাতে না পারলে যে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়, তা আগের বছরগুলোতে দেখা গেছে। এবার অনেক রিটেইলার পরিকল্পনামতো অফারকে কয়েক দিন ছড়িয়ে দিচ্ছে, যাতে গুদাম, কুরিয়ার আর গ্রাহক সেবা—সবই কিছুটা স্বস্তিতে থাকে। এতে অর্ডার বাতিল বা অতিরিক্ত দেরির ঘটনা কমতে পারে, তবে একই সঙ্গে “অতিরিক্ত সময়” যে আসলে পূর্বনির্ধারিত এক ব্যবসায়িক কৌশল, সেটিও পরিষ্কার হয়ে যায়।
আগামীতে সাইবার মানডের রূপ কেমন হতে পারে
অনেক বিশেষজ্ঞের ধারণা, সামনে ব্ল্যাক ফ্রাইডে, সাইবার মানডে আর সাধারণ সাপ্তাহিক ডিল—সব মিলিয়েই এক ধরনের চলমান ছাড় সংস্কৃতি গড়ে উঠবে। বড় বড় টেক সাইটে স্থায়ী “ডিলস” পেজ ইতিমধ্যে দেখা যাচ্ছে, যেখানে তালিকা আপডেট হয়, কিন্তু “সেল শেষ” কথাটা প্রায় শোনা যায় না। এতে একদিকে ধৈর্যশীল ক্রেতা সঠিক মুহূর্তে ভালো দাম পেতে পারে, অন্যদিকে দিনের গুরুত্ব কমে গিয়ে “যে কোনো দিনই অফার”—এই মানসিকতা তৈরি হতে পারে।
ভোক্তার জন্য তাই বড় চ্যালেঞ্জ হলো, এই সবুজ লেবেল আর লাল ব্যানারের মাঝেও নিজের প্রয়োজন আর সামর্থ্যের দিকে তাকিয়ে থাকা। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, প্রথমে প্রশ্ন করুন—এই পণ্যটি আসলে দরকার কি না, কত দিন ধরে চাইছেন, আর সেল না থাকলে এই দামে কিনতেন কি না। যদি উত্তর স্পষ্ট হয়, তবে বাড়তি কয়েক দিনের সাইবার মানডে সত্যিই লাভজনক হতে পারে; না হলে ডিসকাউন্টের উচ্ছ্বাস শেষে কেবল ক্রেডিট-কার্ড বিল আর অপ্রয়োজনীয় বাক্সই হাতে থাকবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















