কাগজে নরম, বাস্তবে দ্রুত অর্থনীতি
অস্ট্রেলিয়ার সাম্প্রতিক ত্রৈমাসিক জিডিপি রিপোর্ট প্রকাশের পর প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল হতাশার; সংখ্যাগুলো দেখাচ্ছিল প্রত্যাশার তুলনায় অনেক কম প্রবৃদ্ধি। সুদের হার বেড়ে যাওয়া, বৈশ্বিক অর্থনীতির গতি কমে আসা এবং পণ্যমূল্যের ওঠানামা—সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল দেশটি ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে আসছে। কিন্তু বিস্তারিত বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র; সামগ্রিক জিডিপি যতটা নরম দেখাচ্ছে, ভেতরের চাহিদা আসলে তার চেয়ে অনেক বেশি উত্তপ্ত। বাড়তি ভোগব্যয়, সরকারি খরচ এবং বিনিয়োগ মিলিয়ে একটি জোরালো অভ্যন্তরীণ চাহিদা অর্থনীতিকে টেনে রাখছে, যদিও পুরোনো উৎস—রপ্তানি থেকে সেই শক্তি অনেকটাই কমে গেছে।
বিশেষ করে নেট এক্সপোর্ট বা রপ্তানি-আমদানি ভারসাম্য জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে বেশ টেনে নামিয়েছে। পণ্য রপ্তানি কমেছে, অন্যদিকে আমদানি বেড়েছে; ফলে কাগজে-কলমে প্রবৃদ্ধির গতি ধীর হয়ে গেছে। অথচ দেশের ভেতরে পরিবারগুলোর খরচ, সরকারি প্রকল্প আর বেসরকারি বিনিয়োগের গতি এখনও এমন পর্যায়ে রয়েছে, যা সাধারণ সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য সতর্ক সংকেত হিসেবে ধরা পড়ত। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, স্থিতিশীল চাকরির বাজার আর কিছু ক্ষেত্রে মজুরি বৃদ্ধির কারণে মানুষ এখনো মোটামুটি খরচ করতে পারছে, যদিও অনেকে তা করছেন সবকিছু কাটছাঁট করে পরিকল্পনা করে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য বাড়তি দোটানা
এই বাস্তবতা রিজার্ভ ব্যাংক অব অস্ট্রেলিয়াকে কঠিন এক অবস্থায় দাঁড় করিয়েছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তারা ধীরে ধীরে সুদের হার বাড়িয়ে মুদ্রাস্ফীতি ঠান্ডা করার চেষ্টা করেছে, যাতে অর্থনীতি মন্দার দিকে না গড়ায়। কিন্তু নতুন তথ্য বলে, অভ্যন্তরীণ চাহিদা যদি এই গতিতেই থাকে, তাহলে মূল্যচাপ কমার বদলে আবারও স্থায়ী হয়ে যেতে পারে। এর মানে হতে পারে—সুদের হার দীর্ঘ সময় উচ্চ পর্যায়ে রাখতে হবে, কিংবা প্রয়োজনে আবারও হার বাড়ানো লাগতে পারে, যা ইতিমধ্যেই চাপের মুখে থাকা গৃহঋণগ্রহীতাদের জন্য বাড়তি বোঝা।
সাধারণ মানুষের জীবনচিত্রেও দ্বৈততা স্পষ্ট। একদিকে চাকরির বাজার এখনো তুলনামূলক মজবুত; লোকবল ঘাটতির কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মী ধরে রাখতে ও টানতে অতিরিক্ত সুবিধা দিতে বাধ্য হচ্ছে। অন্যদিকে বাসাভাড়া, হোম লোনের কিস্তি, বিদ্যুৎ বিল এবং খাবারের দাম—সব মিলিয়ে আয়ের বড় অংশ চলে যাচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাতে। বিভিন্ন জরিপে দেখা যাচ্ছে, পরিবারগুলো বিনোদন, ভ্রমণ ও বড় কেনাকাটায় হাত টানলেও মোট খরচ এখনো পুরোপুরি পড়ে যায়নি; কিন্তু মানসিকভাবে তারা বেশি সাবধানী ও সঞ্চয়মুখী।
ব্যবসাগুলোর অনুভূতিও মিশ্র। খনিজ ও পণ্য রপ্তানিনির্ভর কোম্পানিগুলো চীনের ধীরগতি ও বৈশ্বিক চাহিদা কমে যাওয়া নিয়ে সতর্ক, ফলে বড় বিনিয়োগ স্থগিত করছে। বিপরীতে, নির্মাণ, সেবা ও পরিবহনের মতো দেশীয় খাতগুলোতে কাজের চাপ এখনো বেশি, যদিও শ্রমঘাটতি ও বাড়তি মজুরি খরচ নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তাও কম নয়। উচ্চ সুদের হারের কারণে অনেক প্রতিষ্ঠানকে ভাবতে হচ্ছে, নতুন যন্ত্রপাতি বা ডিজিটাল অবকাঠামোতে বিনিয়োগ এখনই করা উচিত, নাকি আরও কিছুদিন অপেক্ষা করা ভালো।

সরকারি নীতি ও ভবিষ্যতের ঝুঁকি
সরকার এই মুহূর্তে এক ধরনের সূক্ষ্ম ভারসাম্যের খেলায় নেমেছে। একদিকে তারা অর্থনীতির স্থিতিস্থাপকতাকে নিজেদের নীতি সফলতার প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরতে চায়; অন্যদিকে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের পরিবারগুলো ক্রমবর্ধমান খরচ নিয়ে যে সংকটে আছে, সেটিও উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। তাই সামনে প্রশ্ন—সহায়তা কতটা লক্ষ্যভিত্তিক হবে এবং তা কি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রাস্ফীতি কমানোর প্রচেষ্টার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকবে, নাকি বিপরীত প্রভাব ফেলবে।
আন্তর্জাতিক বাজারের বিনিয়োগকারীরাও অস্ট্রেলিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকেন, কারণ পণ্যনির্ভর উন্নত অর্থনীতির ভবিষ্যৎ গতিপথ বোঝার জন্য এটি প্রায়ই পরীক্ষাগার হিসেবে কাজ করে। যদি এমন হয় যে শিরোনামের জিডিপি নম্বর অপেক্ষাকৃত কম, কিন্তু ভেতরের চাহিদা অনেক বেশি গরম থাকে, তাহলে একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে অনেক অন্য দেশও। আপাতত বার্তাটি পরিষ্কার—অস্ট্রেলিয়া নিঃশব্দে মন্দার দিকে এগোচ্ছে না; বরং এক উত্তপ্ত কিন্তু অসম অর্থনীতিকে ঠান্ডা করার কঠিন পরীক্ষায় নামছে, যেখানে সামান্য ভুল পদক্ষেপই ভারসাম্য ভেঙে দিতে পারে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 

















