দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি
২০২৫ সালের শেষ প্রান্তে এসে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বহু দেশ যেন এক দীর্ঘ ডুবে থাকা মৌসুম পার করছে। ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডে দেরিতে আঘাত হানা ঝড় ও টানা বৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যা ও ভূমিধসে ইতিমধ্যে এক হাজার চারশোর বেশি মানুষের মৃত্যুর খবর মিলেছে, নিখোঁজ রয়েছে আরও হাজারের বেশি মানুষ। ইন্দোনেশিয়ার পাহাড়ি ও গ্রামীণ অঞ্চলে কয়েক ঘণ্টার ঝড়ে সেতু, সড়ক ও বিদ্যুৎলাইন ভেসে যাওয়ায় বহু গ্রাম পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, ফলে উদ্ধারকর্মীদের পৌঁছাতেই দেরি হচ্ছে। শ্রীলঙ্কার ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোতে নিরাপদ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে, অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নেওয়া মানুষের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী নিজেই আগাম সতর্কতা ও ত্রাণ সমন্বয়ে ঘাটতির কথা স্বীকার করায় সরকারের প্রস্তুতি নিয়ে সমালোচনাও জোরালো হয়েছে।
মালয়শিয়াতেও বছরের অন্যতম ভয়াবহ বন্যা বহু মানুষকে গৃহহীন করেছে এবং কয়েকজনের মৃত্যু ঘটিয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষি ও নগর অবকাঠামো। অন্যদিকে ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইনে পুরো বছর জুড়েই ঘনঘন ঝড়, ক্রান্তীয় নিম্নচাপ ও পাহাড়ি ধস মানুষ ও অর্থনীতিকে চাপে রেখেছে। ভিয়েতনামের অনুমান, সড়ক, বাঁধ, জমি ও ঘরবাড়ি মেরামতে কয়েক বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত খরচ হতে পারে, আর থাইল্যান্ডের কৃষিখাতে ধানের পাশাপাশি ফল ও সবজির উৎপাদনে বড় ধাক্কার আশঙ্কা করা হচ্ছে। গ্রামীণ দরিদ্র পরিবারগুলোর জন্য এই বন্যা অনেক ক্ষেত্রে বাড়ি, ফসল ও গবাদি পশু একসঙ্গে কেড়ে নিয়ে অনিশ্চয়তাকে আরও গভীর করেছে।
জলবায়ু পরিবর্তন, প্রস্তুতির ঘাটতি ও ভবিষ্যৎ ঝুঁকি
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বছর যা ঘটছে তা কোনো বিচ্ছিন্ন “খারাপ মৌসুম” নয়, বরং উষ্ণায়নের যুগে এশিয়ার জন্য ভবিষ্যতের এক ঝলক। ২০২৪ সালে বায়ুমণ্ডলে তাপ-আটকানো কার্বন ডাই–অক্সাইডের মাত্রা রেকর্ড পরিমাণে বেড়েছে, যা প্রকৃতিকে যেন অতিরিক্ত তাপের জ্বালানি জুগিয়েছে বলে জাতিসংঘ–সমর্থিত আবহাওয়া সংস্থাগুলো সতর্ক করেছে। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, এশিয়া এখন বৈশ্বিক গড়ের প্রায় দ্বিগুণ হারে উষ্ণ হচ্ছে; ফলে উপকূলীয় অঞ্চল, নদী অববাহিকা ও পাহাড়ি ঢাল সবই অতিরিক্ত বৃষ্টি, সমুদ্রপৃষ্ঠ উত্থান ও ঝড়জলোচ্ছ্বাসের সামনে আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে। উষ্ণ সাগর পানি ঝড়কে বেশি শক্তি ও জলীয়বাষ্প দিচ্ছে, ফলে অপেক্ষাকৃত স্বল্প সময়ে ঘনীভূত ঘূর্ণিঝড় ও নিম্নচাপ বেশি বৃষ্টি ঝরাচ্ছে, আর উচ্চ জলোচ্ছ্বাস ভেতরের জনপদ পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে।
আবহাওয়ার ধরণও বদলে যাচ্ছে। এল নিনোসহ বিভিন্ন জলবায়ু-চক্র সাগরের তাপমাত্রাকে বেশি সময় ধরে উষ্ণ রাখায় টাইফুন মৌসুম দীর্ঘ হচ্ছে এবং অনেক ঝড় বছরের শেষ দিকে এসে আঘাত হানছে, যখন অনেকে বর্ষা শেষ হয়ে গেছে ভেবেই নিশ্চিন্ত থাকে। এতে সতর্কতা জারি ও মানুষ সরিয়ে নেওয়ার সময় কমে যাচ্ছে, বিপর্যয় ব্যবস্থাপনা সংস্থাগুলোর ওপর চাপ আরও বাড়ছে। ব্যাংককভিত্তিক দুর্যোগ–প্রস্তুতি কেন্দ্রগুলোর বিশ্লেষণ, দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার বহু সরকার এখনও আগাম ঝুঁকি কমানোর চেয়ে পরবর্তীতে ত্রাণ পরিচালনায় বেশি মনোযোগ দেয়, যার ফলে বাঁধ, ড্রেনেজ, টেকসই বাসস্থান ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য আগাম সতর্কবার্তা ব্যবস্থায় বিনিয়োগ পিছিয়ে আছে।
সমাজের ভেতরে সবচেয়ে বড় আঘাত পড়ছে প্রান্তিক ও দরিদ্র মানুষের ওপর। শ্রীলঙ্কায় মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, পাহাড়ি এলাকা ও চা–বাগানের শ্রমিকদের বসতি বরাবরের মতোই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে, যা ২০০৪ সালের সুনামির সময়ের চিত্রেরই পুনরাবৃত্তি। ইন্দোনেশিয়ায় আবার অনেক গ্রামবাসীর কাছে জমির বৈধ কাগজপত্র না থাকায় পুনর্বাসন বা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার পথ আরও সংকীর্ণ হয়ে গেছে। উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের মতে, আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিল নিয়ে বৈশ্বিক সম্মেলনে নতুন পরিকল্পনা ঘোষিত হলেও বাস্তবে অভিযোজন–সহায়তা এখনও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। তাদের ভাষায়, দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার সামনে এখন দ্বিধা স্পষ্ট—এখনই বড় আকারে বিনিয়োগ করে জলবায়ু সহনশীলতা গড়া, নইলে প্রতি কয়েক বছর পরপরই এমন দুর্যোগের পুনরাবৃত্তি দেখতে হবে, যা কয়েক দিনের মধ্যে বহু বছরের উন্নয়নকে মাটিচাপা দেবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















