জন্ম বন্ধ হচ্ছে, মৃত্যু বেড়ে চলেছে, মানুষ দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে—যুদ্ধের রক্তক্ষয়ের পর ইউক্রেন এখন এমন এক জনসংখ্যাগত বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত, যা ট্যাংক-বোমাও করতে পারেনি। যুদ্ধ থামলেও দেশ কীভাবে পুনর্গঠন করবে—এ প্রশ্নই এখন নিজের অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।
উদ্ভাসহীন প্রসূতি ওয়ার্ড: জীবনের আলোও নিভে যাচ্ছে
পশ্চিম ইউক্রেনের হোশচা শহরের প্রসূতি ওয়ার্ড এমন নীরব যেন দেশটির ভবিষ্যৎও সেখানে শেষ নিঃশ্বাস নিচ্ছে। বছরের শুরু থেকে মাত্র ১৩৯টি শিশু—এক দশকে ৪০০ থেকে নেমে প্রায় অর্ধেকেরও কম।
ডাক্তার ইয়েভহেন হেককেল স্পষ্ট বললেন—
“আমরা শুধু মানুষ হারাচ্ছি না, নিজেদের ভবিষ্যৎও হারাচ্ছি।”

যুদ্ধ-পরবর্তী ইউক্রেন গড়বে কে? প্রশ্নটার কোনো উত্তর নেই
চার বছরের যুদ্ধ লাখো মানুষকে মৃত্যু অথবা দেশত্যাগে ঠেলে দিয়েছে। জন্ম কমছে, পরিবার ভেঙে যাচ্ছে, পুরুষেরা ফ্রন্টলাইনে নিঃশেষ হচ্ছে। সরকার জানে—যুদ্ধ শেষে ইট-বালিও কাজে লাগবে, কিন্তু শ্রমিক কোথায়?
সাদোভের যে স্কুলে একসময় ২০০ শিক্ষার্থী ছিল, আজ তা বন্ধ—শুধু শিক্ষার্থী নেই বলে। এটাই ইউক্রেনের নতুন ভূগোল: যুদ্ধ গ্রাস করছে মানুষ, আর মানুষহীন হচ্ছে ভবিষ্যৎ।
জনসংখ্যার পতন: দেশটি যেন ধীরে ধীরে বিলীন হচ্ছে
যুদ্ধের আগে জনসংখ্যা ৪২ মিলিয়ন। এখন ৩৬ মিলিয়নের নিচে। ভবিষ্যদ্বাণী আরও অন্ধকার—২০৫১ সালে নামতে পারে ২৫ মিলিয়নে।
একটি জন্মের বিপরীতে তিনটি মৃত্যু।
পুরুষদের আয়ু ৬৫ থেকে নেমে ৫৭ বছরে।
নারীদেরও পতন ৭৪ থেকে ৭০ এ।
রাষ্ট্রের মেরুদণ্ড যেন ভেঙে পড়ছে ভেতর থেকেই।

জনসংখ্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা—কাগজে আছে, মাটিতে নেই
সরকার জনসংখ্যা কৌশল ঘোষণা করেছে—অভিবাসন কমাতে হবে, বিদেশে থাকা ইউক্রেনীয়দের ফিরিয়ে আনতে হবে, প্রয়োজনে বিদেশি শ্রমিক আনতে হবে।
কিন্তু যুদ্ধ চলতে থাকলে এসবই কেবল রাজনৈতিক আশ্বাস। বাস্তব হলো—মানুষ বাঁচতে চায়, আর বাঁচতে হলে পালায়।
শহীদের প্রতিকৃতি—হোশচার রাস্তায় লেখা এক জাতির বিলাপ
টাউনহলের সামনে সৈন্যদের প্রতিকৃতি সারি করে দাঁড়ানো। যেন শহর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা নীরব কবর।
২৪ হাজার মানুষের অঞ্চলে ১৪১ জনের মৃত্যু—সংখ্যা ছোট, ব্যথা বিশাল।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক জানান, ছেলে শিক্ষার্থী দ্রুত কমছে—কারণ পরিবারগুলো চেষ্টা করছে সন্তানকে যুদ্ধের আগেই বিদেশে পাঠিয়ে বাঁচাতে।
এটাই নতুন বাস্তবতা: যুদ্ধ শুধু মানুষ হত্যা করছে না, দেশের ভবিষ্যৎও উধাও করে দিচ্ছে।

দেশত্যাগের ঢল: জাতির প্রাণশক্তি বাইরে গলে যাচ্ছে
৫.২ মিলিয়ন মানুষ দেশ ছেড়েছে। এর মধ্যে অন্তত ২ মিলিয়ন আর ফিরবে না। যারা দেশে আছে, তাদের মধ্যেও লিঙ্গ অনুপাত বিশৃঙ্খল—যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের সামাজিক কাঠামো ভেঙে পড়ার আগে-পরে আর কোনো পার্থক্য নেই।
জাতিসংঘের হিসাব আরও নির্মম:
২১০০ সালে ইউক্রেনে জনসংখ্যা নেমে আসতে পারে মাত্র ৯ মিলিয়নে।
একটি জাতির পুরো অস্তিত্বই এক অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে।
পরিত্যক্ত গ্রাম, বন্ধ প্রসূতি ওয়ার্ড: পতনের প্রতীক
হোশচা হাসপাতালের প্রসূতি ওয়ার্ড ২০২৩ সালে অর্থায়ন হারায়—১৭০টি জন্মের লক্ষ্য থেকে মাত্র এক জন্ম কম হওয়ায়। এক শিশুর বিলম্ব, আর একটি পুরো ইউনিট বন্ধ—এ যেন দেশের ভবিষ্যৎ সংখ্যার ওপর নির্ভর করছে মিনিট ও সেকেন্ডের ব্যবধানে।
দুলিবি গ্রাম প্রায় খালি। ২০০ জনের কম মানুষ, তার মধ্যে ৯ জনকে সেনাবাহিনীতে ডাক।

অক্সানা ফর্মানচুকের স্বামী নিখোঁজ; দুই ছেলে সেনাবাহিনীতে যাওয়ার ভয় তাকে প্রতিদিন তাড়া করে।
এ শুধু গল্প নয়—এটি একটি দেশের বিলুপ্তির নীরব বিবরণ।
পরিবার গঠনে ভয়: ভালোবাসার আগে আসে বেঁচে থাকার লড়াই
২১ বছরের আনাস্তাসিয়া ইউশচুক সন্তানের কথা ভাবতেই চান না।
তার বক্তব্য—“দেশে কিছুই স্থিতিশীল নয়। ভবিষ্যৎ বলতে কিছু নেই।”
যুদ্ধ অর্থনীতিকে গিলে খাচ্ছে। বাড়ি কেনা প্রায় অসম্ভব। স্বামী সেনাবাহিনীতে চলে যাওয়ায় বহু নারীর একাকী মাতৃত্বের বোঝা জমছে।

সন্তান—অন্ধকারের ভেতর শেষ অবশিষ্ট আলো
তাবেকোভা বলেন, সন্তান—যুদ্ধের ভাঙাচোরা মনেও একটু আলো জ্বালায়।
যারা হতাশ, যারা প্রিয়জন হারিয়েছেন—তারা সন্তানকে দেখেই মনে করেন, হয়তো লড়াইটা এখনও শেষ হয়ে যায়নি।









# ইউক্রেন #জনসংখ্যা সংকট #যুদ্ধ #অভিবাসন পতন #পুনর্গঠন #গণহ্রাস# ভবিষ্যৎঅস্তিত্ব
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















