রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ৪ ডিসেম্বর তাঁর দশম সফরে নয়াদিল্লিতে। ইউক্রেন যুদ্ধ, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ও শুল্কবৃদ্ধির চাপের মধ্যে এই সফর দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ককে নতুন করে গতিশীল করেছে।
পুতিনের শেষ ভারত সফর ছিল ২০২১ সালে। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন, যার অর্ধেকই রুশ তেল কেনার কারণে ‘শাস্তিমূলক’ পদক্ষেপ বলে দাবি করা হয়। ট্রাম্প বলেন, রাশিয়া থেকে তেল কেনার ওপর ২৫ শতাংশ কর ইউক্রেন যুদ্ধের “অর্থায়নে সহায়তা করে”। ভারত অবশ্য সবসময় বলেছে, তাদের তেল কেনা সম্পূর্ণ জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে।
পুতিনের এই সফরে প্রতিরক্ষা, মহাকাশ, অর্থনীতি ও দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ১০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্য—এসবই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
প্রতিরক্ষা সহযোগিতা
সুখোই এসইউ–৫৭ যুদ্ধবিমান যৌথভাবে উৎপাদন—এই ইস্যুটি আলোচনার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে। আকাশ, নৌ ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার জন্য প্রযুক্তি হস্তান্তর ও বিস্তৃত সামরিক সহযোগিতাও আলোচনায় গুরুত্ব পাবে।
রুশ সংসদের নিম্নকক্ষ ডুমা সম্প্রতি সামরিক সহযোগিতা সংক্রান্ত একটি চুক্তি অনুমোদন করেছে। এর ফলে দু’দেশ আইনগতভাবে নিজেদের ভূখণ্ডে সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েনের সুযোগ পাবে, যা যৌথ মহড়া ও মানবিক সহায়তা কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করবে।

ভারত দীর্ঘদিন ধরে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র। দিল্লি ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ নীতির আওতায় বিদেশি প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলোকে দেশীয় উৎপাদকদের সঙ্গে কাজ করতে উৎসাহিত করছে। দুবাই এয়ারশোতে রুশ রাষ্ট্রায়ত্ত অস্ত্র রপ্তানিকারক রোসোবোরোনএক্সপোর্ট ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের সামনে তাদের সক্ষমতা উপস্থাপন করেছে।
রাশিয়ার ভারতের রাষ্ট্রদূত দেনিস আলিপভ নিশ্চিত করেছেন যে এসইউ–৫৭ এর যৌথ উৎপাদন নিয়ে আলোচনা চলছে।
মহাকাশ সহযোগিতা
রাশিয়ার মহাকাশ সংস্থা রসকসমস জানিয়েছে, ইঞ্জিন নির্মাণ, রকেট জ্বালানি, মানববাহী মহাকাশযান ও জাতীয় কক্ষপথ স্টেশনের উন্নয়ন—এসব ক্ষেত্রেও দুই দেশের সহযোগিতা বিস্তৃত হবে।
১৯৬০-এর দশক থেকেই ভারত-রাশিয়া মহাকাশ খাতে অংশীদার।
১৯৮৪ সালে রাকেশ শর্মা সোভিয়েত সোয়ুজযানে মহাকাশে ভ্রমণ করা প্রথম ভারতীয় হন। ভারতের মানববাহী মহাকাশ মিশন ‘গগনযান’-এও রাশিয়া কাজ করছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক ও ডি-ডলারাইজেশন
সফরের দু’দিন আগে পুতিন ঘোষণা করেন, রাশিয়া ভারতের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও বিস্তৃত করতে চায়।
দু’দেশই তাদের জাতীয় পেমেন্ট সিস্টেম—মির ও রূপে—পারস্পরিক স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে আশাবাদী। পরবর্তী ধাপ হলো রাশিয়ার ফাস্টার পেমেন্ট সিস্টেম (এসবিপি) ও ভারতের ইউনিফাইড পেমেন্টস ইন্টারফেস (ইউপিআই)-কে একীভূত করা।
দুই দেশের বাণিজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশই এখন রুবল ও রুপি—নিজস্ব মুদ্রায় নিষ্পত্তি হচ্ছে।
ক্রেমলিন মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, “ভারতকে যা দেওয়া যায়, সবই ভাগ করা হবে।”
বাণিজ্য সহজীকরণ
এই সফরে দুই দেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর ক্ষেত্রও তৈরি হবে। পাশাপাশি বাণিজ্য, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও সংস্কৃতি—এই পাঁচ খাতে ইন্টার-গভর্নমেন্টাল কমিশনের বৈঠকও পুতিন-মোদির শীর্ষ বৈঠকের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হবে।
ফোরামটি রাশিয়ায় ভারতীয় খাদ্য, কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতির রপ্তানি বাড়ানোর উপায়সহ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ও বৈচিত্র্যায়ন নিয়ে আলোচনা করবে।
দু’দেশ ২০৩০ সালের মধ্যে বাণিজ্য ১০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে চায়। বর্তমানে ভারত রাশিয়ায় প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করে, আর আমদানি করে ৬৪ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য।
রাশিয়া ইতিমধ্যেই বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে এবং এ সমস্যার সমাধান খুঁজতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে।

কূটনৈতিক সম্পর্কের উষ্ণতা
পুতিন ও মোদির ব্যক্তিগত সম্পর্ককে বরাবরই ‘উষ্ণ’ বলা হয়। তারা সর্বশেষ সেপ্টেম্বরে তিয়ানজিনে এসসিও সম্মেলনে সাক্ষাৎ করেন। পুতিনের এই সফর দুই দেশের বার্ষিক শীর্ষ বৈঠকের ঐতিহ্যকেও পুনরুজ্জীবিত করছে।
রুশ উপপ্রধানমন্ত্রী দেনিস মানতুরোভ বলেন, দুই পক্ষই অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে এই সফরের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে, যা সম্পর্কের গভীরতাকে নির্দেশ করে। ভারত সম্প্রতি কাজান ও ইয়েকাতেরিনবুর্গে দুটি নতুন কনস্যুলেট খুলেছে, যা কূটনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির ইঙ্গিত।
ক্রেমলিনও ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ভারতের অবস্থানের প্রশংসা করেছে। পেসকভ বলেন, ভারত রাশিয়ার বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শুনতে আগ্রহী—এটি অত্যন্ত মূল্যবান।
সফরের তাৎপর্য
২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ তীব্র হওয়ার পর এটাই পুতিনের প্রথম ভারত সফর। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ও শুল্কবৃদ্ধির চাপের মধ্যে এ সফর দুই দেশের কৌশলগত সম্পর্কের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
ভারতের যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি কমেছে, যদিও দেশটি এখনও ভারতের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার। দিল্লি ওয়াশিংটনের সঙ্গে কম শুল্কে বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা চালাচ্ছে। অন্যদিকে মস্কো বাণিজ্য ঘাটতি দূর করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
এই বাস্তবতায়, সম্পর্ক জোরদার করতে ভারত ও রাশিয়াকে অত্যন্ত সতর্ক কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায় রেখে অগ্রসর হতে হবে—বিশেষত বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা ও অর্থনৈতিক সহযোগিতায়।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















