থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার বহুদিনের উত্তপ্ত সম্পর্ক আবারও টানাপোড়েনে পড়েছে সীমান্তে নতুন সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ায়। রবিবার শুরু হওয়া গোলাগুলি টানা তিন দিন ধরে মঙ্গলবার পর্যন্ত চলে। এ পর্যন্ত কম্বোডিয়ার सातজন বেসামরিক নাগরিক, থাইল্যান্ডের দুই সৈন্য ও একজন নাগরিক নিহত হয়েছেন। বাস্তুচ্যুত হয়েছেন লাখো থাই এবং হাজারো কম্বোডীয় মানুষ। স্বাধীন পর্যবেক্ষক না থাকায় কে আগে হামলা চালিয়েছে তা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না বলে জানাচ্ছেন আঞ্চলিক কূটনীতিক ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা।
শান্তিচুক্তি ভেঙে যাওয়ার পটভূমি
অক্টোবরের শেষ দিকে কুয়ালালামপুরে দুই দেশের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি সই হয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং আসিয়ান চেয়ার মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম এ চুক্তির সাক্ষী ছিলেন। এর আগে জুলাইয়ে পাঁচ দিনের সীমান্ত সংঘর্ষের পর অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছিল। তবে থাইল্যান্ড গত মাসে অভিযোগ তোলে যে কম্বোডিয়া নতুন করে ল্যান্ডমাইন পুঁতছে, যার পর চুক্তি বাস্তবায়ন স্থগিত করা হয়।
থাইল্যান্ডে কারা লাভবান?
সংঘর্ষ শুরু হয়েছে এমন এক সময়ে যখন থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী আনুতিন চার্নভিরাকুল ব্যাপক চাপের মুখে ছিলেন—দক্ষিণাঞ্চলের ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থতা এবং বহু-বিলিয়ন ডলারের স্ক্যাম ও মানি লন্ডারিংয়ে জড়িত উচ্চপ্রোফাইল ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে দেরি করা নিয়ে সমালোচনা চলছিল।
বিরোধীদল অনাস্থা প্রস্তাবের হুমকি দিয়েছিল, যা দুর্বল সংখ্যালঘু সরকারের ওপর বড় চাপ সৃষ্টি করত।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের থাই গবেষক সুনাই ফাসুক মনে করেন, সংঘর্ষ শুরুর ফলে জাতীয়তাবাদী মনোভাব উসকে উঠেছে এবং সরকার এখন তুলনামূলকভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে।
কম্বোডিয়ার সম্ভাব্য লাভ
জেনেভায় বার্ষিক মাইন ব্যান চুক্তির বৈঠকে কম্বোডিয়া কূটনৈতিক ধাক্কা খায়। সেখানে থাইল্যান্ড নতুন ল্যান্ডমাইন পুঁতে রাখার অভিযোগের আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি করে, যা প্রতিহত করতে কম্বোডিয়া কার্যত ব্যর্থ হয়।
অ্যান্টি-মাইন পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন, নতুন সংঘর্ষ তদন্তপ্রক্রিয়াকে কার্যত থামিয়ে দেবে। ল্যান্ডমাইন মনিটরের ইয়েশুয়া মোসার-পুয়াংসুয়ান জানান, জুলাইয়ে বিস্ফোরণ হওয়া চং আন মা এলাকায় আবার সংঘর্ষ শুরু হওয়ায় তদন্ত শুরু করাই কঠিন হয়ে পড়বে।
থাই সামরিক বাহিনীর ভূমিকা
ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণকে কেন্দ্র করে শান্তিচুক্তি স্থগিত করার পর প্রধানমন্ত্রী আনুতিন সেনাবাহিনীকে সীমান্ত নিরাপত্তা নীতিতে পূর্ণ স্বাধীনতা দেন। সোমবার ‘ওয়ার ক্যাবিনেট’-এর প্রথম বৈঠকের আগেই থাই বিমানবাহিনী কম্বোডীয় সামরিক স্থাপনায় বিমান হামলা চালায়।
বিশ্লেষকদের মতে, সীমান্তের পরিস্থিতি এখন পুরোপুরি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে, এবং তাদের লক্ষ্য কম্বোডিয়ার সামরিক ঘাঁটিগুলোকে অকার্যকর করে দেওয়া।

কম্বোডিয়ার সামরিক কৌশল
থাই সামরিক বাহিনী ক্ষমতাধর; তুলনায় কম্বোডিয়া দুর্বল—সংঘাতের বাস্তবতা এটি। ফনোম পেনের কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, কম্বোডীয় সামরিক কর্মকর্তারাও স্বীকার করছেন যে প্রচলিত যুদ্ধে তারা থাই বাহিনীর সমকক্ষ নন।
তবে এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়েই নিজেদের ‘বুলিড প্রতিবেশী’ হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলে উপস্থাপন করতে চাইছে কম্বোডিয়া, যাতে থাইল্যান্ডের সামরিক অবস্থানের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক সহানুভূতি তৈরি হয়।
শান্তির সম্ভাবনা কতটা?
বর্তমানে শান্তির সম্ভাবনা ক্ষীণ। কুয়ালালামপুরের মধ্যস্থতায় নতুন করে শান্তিচেষ্টা চালানোর উদ্যোগকে থাইল্যান্ড ইতিবাচকভাবে দেখছে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং রাজনৈতিক মহলে মালয়েশিয়ার আনোয়ার ইব্রাহিমের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
অন্যদিকে কম্বোডিয়া প্রকাশ্যে সংযম দেখানোর চেষ্টা করছে। প্রধানমন্ত্রী হুন মানেত জানিয়েছেন, তারা শান্তিপূর্ণ সমাধান চান, তবে দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন কোনোভাবেই বরদাস্ত করা হবে না।
দুই দেশের সীমান্ত উত্তেজনা বহু বছরের পুরোনো। বর্তমান সংঘর্ষ সেই সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলেছে। সামরিক আগ্রাসন, কূটনৈতিক টানাপোড়েন ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপ—সব মিলিয়ে এই সংকট দ্রুত শেষ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















