চীনের কূটনৈতিক ক্ষোভ যেন কখনোই ফুরিয়ে যায় না, শুধু লক্ষ্যবস্তু বদলায়। কিছুদিন আগেও কানাডা ও দক্ষিণ কোরিয়া ছিল বেইজিংয়ের রোষানলে। এখন সেই জায়গায় আবার জাপান। তাইওয়ান ইস্যুতে সম্ভাব্য সামরিক অবস্থানের কথা বলায় জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচির মন্তব্যকে ‘লাল রেখা অতিক্রম’ হিসেবে দেখছে চীন। বেইজিংয়ের চোখে এটি অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ, যার ঐতিহাসিক ক্ষত আরও গভীর।
লাল রেখা ও প্রতিক্রিয়ার রাজনীতি
চীনের কড়া বক্তব্য সাধারণত কথার মধ্যেই থামে না। জাপানের ক্ষেত্রে সামুদ্রিক খাবার আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা, নাগরিকদের জাপান ভ্রমণে সতর্কতা, জাপানি কনসার্ট ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনী বাতিল—সব মিলিয়ে চাপের স্পষ্ট বার্তা। বাইরে থেকে এগুলো আবেগী বা আত্মঘাতী মনে হলেও চীনের কাছে এগুলো পরিকল্পিত হাতিয়ার।

‘ডগহাউস কূটনীতি’ কীভাবে কাজ করে
দুই দশকের অভিজ্ঞতায় চীন এমন এক কৌশল গড়ে তুলেছে, যেখানে শাস্তির উপস্থিতিই আসল বার্তা। কোন দেশ কতটা শাস্তি পেল, তার চেয়ে বড় বিষয় হলো—এই ভয় দেখানো ব্যবস্থার অস্তিত্ব। ফলে বহু দেশ চীনের ঘোষিত স্বার্থের আশপাশে হাঁটতে আরও সতর্ক হয়।
বাণিজ্যকে অস্ত্র বানানোর ইতিহাস
তিব্বতের ধর্মীয় নেতা দালাই লামার সঙ্গে বৈঠক, নোবেল শান্তি পুরস্কার বিতর্ক, দক্ষিণ চীন সাগরের সংঘর্ষ, ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা—এমন নানা ঘটনায় চীন অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগ করেছে। গবেষকদের তথ্য অনুযায়ী, গত দেড় দশকে বিশ্বজুড়ে ‘অস্ত্রায়িত বাণিজ্য’-এর বহু ঘটনার পেছনে চীনের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।
ঘোষণা নয়, ইঙ্গিতের শাস্তি
চীন সচরাচর শাস্তির কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করে না। সময় ও লক্ষ্যবস্তুর মিলই উদ্দেশ্য স্পষ্ট করে দেয়। তাইওয়ান নাম ব্যবহারের ঘটনায় লিথুয়ানিয়ার পণ্য হঠাৎ শুল্ক ব্যবস্থায় অদৃশ্য হয়ে যাওয়া বা কানাডার ক্যানোলা রপ্তানি বন্ধ—সবই ‘অঘোষিত’ শাস্তির উদাহরণ।

স্বল্পমেয়াদে ব্যর্থ, দীর্ঘমেয়াদে প্রভাব
তাৎক্ষণিকভাবে দেখলে চীনের চাপ সব সময় ফল দেয় না। দক্ষিণ কোরিয়া ক্ষেপণাস্ত্র বসিয়েছে, লিথুয়ানিয়া অবস্থান বদলায়নি, জাপানও পিছু হটছে না। কিন্তু বড় ছবিতে দেখা যায়, অনেক দেশই পরবর্তী সময়ে সতর্ক হয়েছে। দালাই লামার সঙ্গে বৈঠক কমেছে, তাইওয়ান নাম ব্যবহারে সংযম বেড়েছে, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশ ভাষা নরম করেছে।
কম খরচে বড় চাপ
চীনের ক্ষতি তুলনামূলক কম। এক দেশ থেকে পণ্য কমলে অন্য দেশ থেকে আমদানি বাড়ে। পর্যটন বাতিল হলে ব্যয় অন্যত্র সরে যায়। কিন্তু লক্ষ্যবস্তু দেশের কোম্পানির ক্ষতি বড়, কারণ চীনা বাজার বিশাল। কম আত্মক্ষতি, বড় বিদেশি চাপ—এটাই কৌশলের সারকথা।

ভাবমূর্তির ক্ষয় কি গুরুত্বহীন
এই কৌশলে চীনের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায় চীনের প্রতি অনাস্থা বেড়েছে। তবু বেইজিংয়ের হিসাব ভিন্ন। মাঝেমধ্যে ‘বুলি’ হিসেবে পরিচিত হওয়া তারা মেনে নিচ্ছে, কারণ এতে সরকারগুলোকে শৃঙ্খলায় রাখা সহজ হয়।
জাপানকে বার্তা, বাকিদের সতর্কতা
জাপানকে শাস্তি দিয়ে চীন শুধু প্রতিশোধ নিচ্ছে না, লাল রেখাগুলো মোটা দাগে আঁকছে। তাইওয়ানের স্বাধীনতার ইঙ্গিত পেলেই কঠোর প্রতিক্রিয়া—এই বার্তাই পৌঁছাতে চায় বেইজিং। অন্যদের জন্য সতর্ক সংকেত স্পষ্ট।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















