এনএমসি গ্রুপের পতন ঘিরে দীর্ঘদিনের আইনি জটিলতায় নতুন মোড় এনেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ২০২৫ সালের অর্থপাচারবিরোধী আইন। এই আইনের ব্যাখ্যার ভিত্তিতে আদালত প্রথমবারের মতো ব্যাংক অব বরোদার গোপন লেনদেন নথি আদালতে তলবের পথ খুলে দিয়েছে।
বিআর শেঠির অবস্থান ও মামলার প্রেক্ষাপট
এনএমসি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা বিআর শেঠি বরাবরই দাবি করে আসছেন, তিনি সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তাদের পরিচালিত একটি ‘জটিল প্রতারণা’র শিকার। ২০২০ সাল থেকে এনএমসি ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে লুকানো ঋণ ও আর্থিক অনিয়ম প্রকাশ্যে আসার পর সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, ভারতসহ একাধিক দেশে তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত ও মামলা চলছে।
ব্যাংক অব বরোদা কেন গুরুত্বপূর্ণ
ভারতের শীর্ষ পাঁচ ব্যাংকের একটি ব্যাংক অব বরোদার নাম উঠে এসেছে এনএমসি পতনের কেন্দ্রে থাকা বিতর্কিত লেনদেনের সঙ্গে। বর্তমানে প্রশাসনের অধীনে থাকা এনএমসি জানতে চায়, ব্যাংকটি কী জানত, কখন জানত এবং সন্দেহজনক লেনদেন শনাক্তে তাদের অর্থপাচারবিরোধী ব্যবস্থা কীভাবে কাজ করেছে।

এসটিআর কী এবং এর গুরুত্ব
সংযুক্ত আরব আমিরাতে কোনো ব্যাংক যদি মনে করে কোনো হিসাবে থাকা অর্থ অপরাধের সঙ্গে যুক্ত বা অস্বাভাবিক, তাহলে তাকে ‘সাসপিশাস ট্রানজ্যাকশন রিপোর্ট’ বা এসটিআর জমা দিতে হয়। এসব প্রতিবেদন পাঠানো হয় দেশের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে। তদন্তে বিঘ্ন ও গ্রাহককে সতর্ক করে দেওয়ার ঝুঁকি এড়াতে এসব নথি সাধারণত কঠোরভাবে গোপন রাখা হয়।
এনএমসি আদালতের কাছে যে নথি চেয়েছে
এনএমসি আদালতে আবেদন করে ব্যাংক অব বরোদার কাছ থেকে এনএমসি-সম্পর্কিত সব এসটিআর, ব্যাংকের ভেতরে তৈরি অভ্যন্তরীণ অর্থপাচারবিরোধী প্রতিবেদন এবং এমন ঘটনাগুলোর ব্যাখ্যা চেয়েছে, যেখানে সন্দেহ উঠলেও এসটিআর দাখিল না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এনএমসির দাবি, এসব নথি থেকে বোঝা যাবে ব্যাংকটি ঝুঁকির ইঙ্গিত পেয়েছিল কি না এবং পেয়ে থাকলে কী ব্যবস্থা নিয়েছিল।
আইন বদলে কীভাবে পরিস্থিতি পাল্টাল
এর আগে ২০১৮ সালের অর্থপাচারবিরোধী আইনের অধীনে আদালত মনে করেছিল, দেওয়ানি মামলায় এসটিআর প্রকাশ করা অপরাধ। সেই যুক্তিতে চলতি বছরের জুনে আদালত ব্যাংক অব বরোদাকে এসব নথি প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। কিন্তু ১৪ অক্টোবর কার্যকর হওয়া ২০২৫ সালের নতুন ফেডারেল ডিক্রি আইন একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা যুক্ত করে, যেখানে বলা হয়—আইনে অনুমোদিত অন্য পরিস্থিতিতে এসব তথ্য প্রকাশ করা যেতে পারে।

বিচারকের ব্যাখ্যা ও সিদ্ধান্ত
২৬ নভেম্বরের রায়ে বিচারপতি স্যার অ্যান্ড্রু স্মিথ বলেন, নতুন আইনের ফলে পরিস্থিতিতে মৌলিক পরিবর্তন এসেছে। তিনি আরবি শব্দগুচ্ছ ‘আল মুসাররাহ বিহা’র ব্যাখ্যা দিয়ে জানান, আদালতের আদেশে দেওয়ানি মামলায় নথি প্রকাশ এখন আইনসম্মত। ফলে আগের নিষেধাজ্ঞা পুনর্বিবেচনার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
তিনটি আবেদন ও রায়
আদালতে তিনটি আবেদন ওঠে। প্রথমত, এনএমসির আবেদনে আগের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের অনুরোধ। দ্বিতীয়ত, এনএমসির পক্ষ থেকে এসটিআর ও সংশ্লিষ্ট নথি প্রকাশের আবেদন। তৃতীয়ত, ব্যাংক অব বরোদার আবেদন—নিষেধাজ্ঞার পরিসর বাড়িয়ে অভ্যন্তরীণ নথিও গোপন রাখার অনুরোধ।
বিচারক এনএমসির দুই আবেদনই নীতিগতভাবে মঞ্জুর করেন এবং ব্যাংক অব বরোদার আবেদন খারিজ করেন। তিনি জানান, শর্তসাপেক্ষে ব্যাংককে নথি খুঁজে প্রকাশ করতে হবে। একই সঙ্গে আইনজীবীদের বিস্তারিত আদেশের খসড়া ও খরচের বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছাতে নির্দেশ দেন।

গোপনীয়তা ও ন্যায়বিচারের ভারসাম্য
রায়ে বিচারক স্বীকার করেন, এসটিআর অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং ভুলভাবে প্রকাশ করলে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। তবে তাঁর মতে, এনএমসির অভিযোগ গুরুতর এবং এসব নথি ব্যাংকটি তার দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করেছে কি না, তা নির্ধারণে সহায়ক হতে পারে। এমনকি কোনো এসটিআর দাখিল না হওয়ার তথ্যও মামলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
তদন্ত সুরক্ষায় সম্ভাব্য ব্যবস্থা
বিচারক প্রস্তাব দেন, কোনো নথি প্রকাশ তদন্তে ক্ষতি করতে পারে কি না—সে বিষয়ে ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আপত্তি জানানোর সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি খোলা আদালতে এসব নথির ব্যবহার ও আলোচনায় সীমাবদ্ধতাও আরোপ করা যেতে পারে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















