ক্যানসারের চিকিৎসা নিতে দেশ ছাড়ার পরই পলাতক ঘোষণা করা হয় সাবেক চীনা কর্মকর্তা লি চুয়ানলিয়াংকে। এরপর দক্ষিণ কোরিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্র—যেখানেই গেছেন, সেখানেই তাকে অনুসরণ করেছে চীনের নজরদারি যন্ত্র। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এই বৈশ্বিক নজরদারির বড় অংশই সম্ভব হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের সফটওয়্যার দিয়ে।
বিদেশে পালানোর শুরু
অবসরপ্রাপ্ত চীনা কর্মকর্তা লি চুয়ানলিয়াং কোরিয়ার একটি পর্যটন দ্বীপে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সেখানেই হঠাৎ এক বন্ধুর ফোন—দেশে ফিরবেন না, আপনাকে পলাতক ঘোষণা করা হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যেই এক অচেনা ব্যক্তি ক্যাফেতে তার ছবি তোলে। দক্ষিণ কোরিয়া তাকে চীনে ফেরত পাঠাতে পারে—এই ভয়ে লি যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যান, আশ্রয়ের আবেদন করেন।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রেও স্বস্তি মেলেনি। নিউইয়র্ক, ক্যালিফোর্নিয়া কিংবা টেক্সাসের মরুভূমি—সবখানেই তাকে অনুসরণ করা হয়েছে। ফোন ও অনলাইন যোগাযোগ নজরদারিতে রাখা হয়েছে, সম্পদ জব্দ করা হয়েছে, পুলিশি ডাটাবেসে তার চলাফেরা ট্র্যাক করা হয়েছে।

পরিবার ও পরিচিতদের ওপর চাপ
লি’র ওপর চাপ বাড়াতে তার পরিবার ও পরিচিতদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়। ৪০ জনের বেশি বন্ধু, আত্মীয় ও সহকর্মী—এমনকি তার অন্তঃসত্ত্বা কন্যাকেও শনাক্ত করে আটক করা হয়। মুখ শনাক্তকরণ প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাদের ট্যাক্সিচালকদের পর্যন্ত খুঁজে বের করা হয়েছে। তিনজন সাবেক সহযোগী হেফাজতে মৃত্যুবরণ করেন বলে নথিতে উল্লেখ রয়েছে।
লি বলেন, আপনার ফোন, ইলেকট্রনিক যন্ত্র—সবকিছুই তাদের হাতে। আপনি যেখানে থাকুন, তারা আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
নজরদারির বৈশ্বিক বিস্তার
চীনা সরকার ঘরে ও বাইরে নিজেদের ক্ষমতা জোরদার করতে নজরদারি প্রযুক্তিকে প্রধান হাতিয়ার বানিয়েছে। রাষ্ট্রীয় হিসাব অনুযায়ী, শুধু গত বছরই এই প্রযুক্তির সহায়তায় প্রায় নয় লাখ কর্মকর্তাকে শনাক্ত ও শাস্তি দেওয়া হয়েছে, যা ২০১২ সালের তুলনায় পাঁচ গুণের কাছাকাছি।
সরকার বলছে, এটি দুর্নীতিবিরোধী অভিযান। কিন্তু সমালোচকদের মতে, এই প্রযুক্তি ভিন্নমত দমন ও প্রতিশোধ নিতেই বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে।

বিদেশে ‘ফক্স হান্ট’ ও ‘স্কাই নেট’
চীনের বাইরে পালিয়ে যাওয়া কর্মকর্তা ও ভিন্নমতাবলম্বীদের ফেরাতে চালু হয় ‘ফক্স হান্ট’ ও ‘স্কাই নেট’ অভিযান। যুক্তরাষ্ট্রসহ ১২০টির বেশি দেশ থেকে প্রায় ১৪ হাজার মানুষকে দেশে ফিরিয়ে আনার দাবি করেছে বেইজিং। যুক্তরাষ্ট্র এই অভিযানকে সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি বলে অভিহিত করেছে।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ইয়াকিউ ওয়াং বলেন, এর মূল উদ্দেশ্য হলো দেখানো—চীন থেকে পালিয়ে বাঁচার কোনো উপায় নেই।
সিলিকন ভ্যালির প্রযুক্তির ভূমিকা
এপি’র অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত এক দশকে ব্যবহৃত এই নজরদারি প্রযুক্তির বড় অংশ এসেছে আইবিএম, ওরাকল ও মাইক্রোসফটের মতো যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান থেকে। এই সফটওয়্যারগুলো টেক্সট, অর্থ লেনদেন, ভ্রমণ, ফোনকলসহ নানা তথ্য বিশ্লেষণ করে লক্ষ্যবস্তুর পরিবার ও সম্পদের নেটওয়ার্ক চিহ্নিত করতে সাহায্য করে।
আইবিএমের আইটু সফটওয়্যার চীনের অর্থনৈতিক অপরাধ তদন্ত ব্যুরোতে বিক্রির প্রমাণ পাওয়া গেছে। পরে আইবিএমের এক সাবেক অংশীদার ল্যান্ডাসফট এই সফটওয়্যার নকল করে আরও বিস্তৃত নজরদারি ব্যবস্থায় রূপ দেয়। এসব বিক্রি যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করেনি।

লি চুয়ানলিয়াংয়ের উত্থান ও পতন
লি উত্তর-পূর্ব চীনের জিসি শহরে হিসাবরক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কারণে তাকে একসময় ‘দুর্নীতিবিরোধী দুর্গ’ বলা হতো। পরে তিনি শহরের উপমেয়র হন।
কিন্তু নতুন পার্টি প্রধান শু ঝাওজুনের বিলাসী জীবন ও দুর্নীতির প্রমাণ সামনে এলে লি নীরব থাকতে পারেননি। তিনি প্রমাণসহ অভিযোগ দাখিল করেন। শুরুতে প্রতিশোধ নেমে এলেও শেষ পর্যন্ত শু গ্রেপ্তার হন এবং ১৪ বছরের কারাদণ্ড পান।
এই অভিজ্ঞতায় লি পার্টির ওপর আস্থা হারান এবং পদত্যাগ করেন।
শি জিনপিং যুগে অভিযান
২০১২ সালে শি জিনপিং ক্ষমতায় আসার পর ‘বাঘ ও মাছি’ ধরার নামে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু হয়। একই সঙ্গে নজরদারি আরও শক্তিশালী হয়। বড় ডেটা সেন্টার, অনলাইন রিপোর্টিং পোর্টাল এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার নামে পালিয়ে যাওয়া কর্মকর্তাদের খোঁজ বাড়ে।
এপি’র হাতে আসা নথিতে দেখা যায়, বিদেশে থাকা ব্যক্তিদের ধরতে পরিবারকে চাপ দেওয়াই ছিল মূল কৌশল।

লি’র বিরুদ্ধে অভিযোগ ও প্রতিশোধ
২০২০ সালে লি প্রকাশ্যে পার্টির সমালোচনা শুরু করলে কেন্দ্রীয় সরকার সরাসরি জড়িয়ে পড়ে। তার ফোনে আড়ি পাতা হয়, সম্পদ জব্দ করা হয়, আত্মীয়দের বাড়ির বাইরে ক্যামেরা বসানো হয়। অসুস্থ আত্মীয়দের চিকিৎসাও বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
২০২৪ সালে চীনা আদালত জানায়, লি’র বিরুদ্ধে প্রায় ৪৩৫ মিলিয়ন ডলারের দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে এবং তার সঙ্গে জড়িত শতাধিক সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। আইনজীবীরা বলছেন, মামলায় গুরুতর অসঙ্গতি রয়েছে এবং এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
ভয়, নজরদারি ও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি হলেও লি আপত্তি জানালে তা প্রত্যাহার করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে তিনি একের পর এক নিরাপদ আশ্রয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, মুখে মাস্ক ও মাথায় টুপি পরে চলাফেরা করছেন।
ট্রাম্প প্রশাসন আশ্রয় আবেদন স্থগিত রাখায় তার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। দেশে ফেরত পাঠানো হলে আজীবন কারাদণ্ডের আশঙ্কা রয়েছে।
লি বলেন, ইলেকট্রনিক নজরদারিই চীনের বৈশ্বিক ক্ষমতার শিরা-উপশিরা। আপনার পরিবারের প্রতিটি পদক্ষেপ বিশ্লেষণ করা হয়। এটা ভয়াবহ।
শেষ কথা
পরিবার ও বন্ধুবান্ধব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে লি এখন ইউটিউবে নিজের কথা বলছেন। তিনি জানেন, লড়াই কঠিন। তবু থামছেন না।
লি’র ভাষায়, আজ আমি—কাল হয়তো আপনি।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















