গাজায় যুদ্ধবিরতির ঠিক আগে তিন মাসে জন্মের দিনই মারা যাওয়া নবজাতকের সংখ্যা যুদ্ধ-পূর্ব সময়ের তুলনায় প্রায় ৭৫ শতাংশ বেড়েছে। জাতিসংঘ শিশু তহবিল ইউনিসেফের তথ্য বলছে, এই সংকটের পেছনে রয়েছে মাতৃ অপুষ্টি, চরম মানসিক চাপ এবং ভেঙে পড়া স্বাস্থ্যব্যবস্থা।
নবজাতক মৃত্যুর উদ্বেগজনক পরিসংখ্যান
ইউনিসেফের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর—এই তিন মাসে গাজায় জন্মের দিনই মারা গেছে ১৪১টি শিশু। যুদ্ধের আগে এমন মৃত্যু ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক কম। একই সময়ে প্রতি মাসে গড়ে ১ হাজার ৩৮০টি কম ওজনের নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে, যা যুদ্ধ-পূর্ব সময়ের দ্বিগুণ।
কম ওজন নিয়ে জন্ম নেওয়া শিশুর সংখ্যা বেড়েছে
২০২৫ সালের শুরু থেকেই গাজায় কম ওজন নিয়ে জন্ম নেওয়া শিশুর সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। যুদ্ধের আগে প্রতি মাসে গড়ে ২৫০টি কম ওজনের শিশু জন্ম নিত। কিন্তু বছরের প্রথম ছয় মাসে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩০০-তে। জুলাইয়ের পর থেকে এই সংখ্যা আরও বেড়ে প্রতি মাসে প্রায় ৪৬০-এ পৌঁছেছে। মোট জন্মের হিসাব ধরলে দেখা যাচ্ছে, এই সময়ে ১০ শতাংশের বেশি শিশু জন্ম নিচ্ছে প্রয়োজনের তুলনায় কম ওজন নিয়ে। যুদ্ধের কারণে সামগ্রিক জন্মহার কমে যাওয়াও এই হারের বৃদ্ধি আরও স্পষ্ট করেছে।

মাতৃ অপুষ্টি ও চিকিৎসা সংকটের প্রভাব
ইউনিসেফ জানায়, কম ওজন নিয়ে শিশুর জন্ম সাধারণত মাতৃ অপুষ্টি, অতিরিক্ত মানসিক চাপ এবং গর্ভকালীন চিকিৎসার অভাবের ফল। গাজায় এই তিনটি সমস্যাই একসঙ্গে তীব্র আকার ধারণ করেছে। জেনেভায় এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে ইউনিসেফের যোগাযোগ ব্যবস্থাপক টেস ইনগ্রাম বলেন, প্রয়োজনের তুলনায় খুব ধীরগতিতে এবং অপ্রতুল মাত্রায় সহায়তা পৌঁছাচ্ছে।
খাদ্য সংকটের পরিণতি
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জুলাই মাসেই অপুষ্টিজনিত উচ্চ মৃত্যুহারের বিষয়ে সতর্ক করেছিল। এরপর ইসরায়েল তুলনামূলক বেশি পরিমাণ খাদ্য প্রবেশের অনুমতি দিলে আগস্টের শুরুতে খাদ্যের দাম কিছুটা কমে এবং অপুষ্টিজনিত রোগের হারও আংশিকভাবে কমে। তবে যে নারীরা খাদ্য সংকটের সবচেয়ে কঠিন সময়ে গর্ভবতী ছিলেন, তাঁদের সন্তানরা জন্ম নিয়েছে কম ওজন নিয়ে। এসব শিশু রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে এবং জন্মের সময় বা পরবর্তী কয়েক মাসে মৃত্যুর ঝুঁকিতে পড়ছে। এই ঝুঁকি আরও বেড়েছে গাজার স্বাস্থ্যসেবার চরম দুরবস্থার কারণে।
গর্ভবতী নারীদের ভয়াবহ অপুষ্টি
ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে পরীক্ষা করা গর্ভবতী নারীদের প্রায় ৩৮ শতাংশই গুরুতর অপুষ্টিতে ভুগছিলেন। টেস ইনগ্রাম জানান, তিনি গাজায় এমন নবজাতক দেখেছেন যাদের ওজন এক কেজিরও কম। তাদের ছোট বুক বাঁচার চেষ্টায় কষ্ট করে ওঠানামা করছিল। তিনি বলেন, কম ওজনের শিশুর মৃত্যুঝুঁকি স্বাভাবিক ওজনের শিশুর তুলনায় প্রায় ২০ গুণ বেশি।

ভেঙে পড়া স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও চিকিৎসার অভাব
ইনগ্রাম আরও বলেন, এসব নবজাতকের জন্য বিশেষ চিকিৎসা প্রয়োজন, যা গাজার বহু হাসপাতাল দিতে পারছে না। স্বাস্থ্য অবকাঠামো ধ্বংস, চিকিৎসাকর্মীদের মৃত্যু ও বাস্তুচ্যুতি এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম প্রবেশে বাধার কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। তাঁর মতে, মায়ের অপুষ্টি থেকে সন্তানের মৃত্যুর যে ধারাবাহিক বিপর্যয়, তা আগেই ঠেকানো যেত। একটি শিশুর প্রথম নিঃশ্বাস নেওয়ার আগেই যুদ্ধের শিকার হওয়া কখনোই মেনে নেওয়া যায় না।
শিশু অপুষ্টির বিস্তৃত চিত্র
জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, খাদ্য পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হলেও আগস্ট মাসে গাজায় প্রায় ৬ হাজার শিশু গুরুতর অপুষ্টিতে ভুগছিল। আগস্টের প্রথম দুই সপ্তাহে ৫৮ হাজার ৬১৭ শিশুকে পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ১০ শতাংশের শরীরে গুরুতর অপুষ্টি ধরা পড়ে, যা যুদ্ধ শুরুর পর থেকে সবচেয়ে বেশি।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















