ব্রাজিলের উত্তর প্রান্তে আমাজন অববাহিকার কিনারে ছোট শহর ওইয়াপোক। একসময় নীরব, পিছিয়ে থাকা এই জনপদে এখন বদলের হাওয়া। নতুন হোটেল উঠছে, বিমানবন্দর সংস্কার হয়েছে, আকাশে বাড়ছে হেলিকপ্টারের শব্দ। জেলে, আদিবাসী আর সীমান্তের পর্যটকদের ভিড়ে থাকা শহরটি ধীরে ধীরে প্রস্তুত হচ্ছে তেলভিত্তিক অর্থনীতির নতুন অধ্যায়ের জন্য
লাইসেন্স মিলতেই তেল নগরীর স্বপ্ন
চলতি বছরের অক্টোবরে ব্রাজিলের পরিবেশ নিয়ন্ত্রক সংস্থা পেট্রোব্রাসকে ওইয়াপোক উপকূল থেকে প্রায় একশ মাইল দূরে তেল অনুসন্ধানের অনুমতি দেয়। দীর্ঘদিন ধরে প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভার চাপের পর আসে এই সিদ্ধান্ত। পাশের গায়ানায় বিপুল তেলের সন্ধান ব্রাজিলের নীতিনির্ধারকদের আরও তৎপর করে তোলে। সরকার মনে করছে, নতুন এই তেলক্ষেত্র দেশের কমে আসা মজুতের ঘাটতি পুষিয়ে দেবে।
শেষের পথে পুরনো মজুত
দুই হাজার ছয়ের পর রিও দে জেনেইরোর উপকূলে গভীর সমুদ্রে আবিষ্কৃত তেল ব্রাজিলকে বড় উৎপাদকদের কাতারে তুলেছিল। সেই মজুত থেকে এখনো উত্তোলন চলছে, কিন্তু আগামী দশকের পর তা ফুরোতে শুরু করবে বলে আশঙ্কা। সরকার হিসাব করছে, নতুন ক্ষেত্র না এলে দুই হাজার চল্লিশের পর ব্রাজিল আবার তেল আমদানিকারক হয়ে পড়তে পারে। এই আশঙ্কাই আমাজন সংলগ্ন নতুন সম্ভাবনাকে সামনে আনছে।
সমৃদ্ধির আশা, বিপুল বিনিয়োগ
সরকারি হিসেবে সমতলীয় অঞ্চলে তেল অনুসন্ধান ও উত্তোলনে কয়েক শ’ বিলিয়ন রিয়ালের বিনিয়োগ হতে পারে। তৈরি হতে পারে লক্ষাধিক কর্মসংস্থান। এই আশাই ওইয়াপোকসহ আশপাশের এলাকার মানুষের চোখে স্বপ্ন জাগাচ্ছে। স্থানীয় বাজারে ব্যবসায়ীরা বলছেন, তেল এলে কাজ বাড়বে, টাকা আসবে, জীবন বদলাবে। সাম্প্রতিক জরিপেও দেখা যাচ্ছে, তেল অনুসন্ধানের পক্ষে জনসমর্থন আগের চেয়ে বেড়েছে।
প্রকৃতির বুকে বড় ঝুঁকি
কিন্তু এই সম্ভাবনার সঙ্গেই জড়িয়ে আছে বড় ঝুঁকি। আমাজন নদীর মোহনা পৃথিবীর অন্যতম জীববৈচিত্র্য পূর্ণ অঞ্চল। প্রতিদিন বিপুল মিঠা পানি সাগরে মিশে যায়, ম্যানগ্রোভ বন আর অজানা প্রজাতির মাছ এই এলাকাকে করেছে সংবেদনশীল। গভীর সমুদ্রে প্রবল স্রোত ও জটিল ভূগঠন তেল উত্তোলনকে কঠিন করে তুলেছে। দুর্ঘটনার আশঙ্কা নিয়ে উদ্বিগ্ন আদিবাসী নেতারা বলছেন, অন্যত্র তেল ছড়িয়ে পড়ার দৃশ্য তারা দেখেছেন, এখানেও যে তা হবে না তার নিশ্চয়তা কে দেবে।
উন্নয়নের আগেই চাপ
তেল উত্তোলন শুরু হতে এখনও সময় লাগবে, কিন্তু তার আগেই শুরু হয়েছে জনসংখ্যার চাপ। নতুন কাজের আশায় মানুষ আসছে, বন পরিষ্কার হচ্ছে, স্কুল ও হাসপাতাল উপচে পড়ছে। স্থানীয় প্রশাসন মানছে, এই পরিবর্তন সামাল দেওয়া বড় চ্যালেঞ্জ। দুর্নীতির আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না অনেকে।
সবুজ লক্ষ্য আর বাস্তবতার টানাপোড়েন
লুলা সরকার বলছে, তেল থেকে আসা অর্থই ভবিষ্যতে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগের পথ খুলে দেবে। স্বল্পমেয়াদে জ্বালানি নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতি, আর দীর্ঘমেয়াদে সবুজ রূপান্তর—এই দুই লক্ষ্য একসঙ্গে এগোনোর কৌশল নিয়েছে সরকার। আমাজনের জলে মাছের ঝাঁক যেমন নির্বিকার ভেসে চলে, তেমনি উন্নয়ন আর পরিবেশের এই দ্বন্দ্ব কোন পথে যাবে, তা নিয়েই এখন বড় প্রশ্ন।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















