নওগাঁ বাইপাস সড়কের দুপাশে একসময় নীরব প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকত উঁচু উঁচু তালগাছ। সারি সারি এই গাছগুলো কেবল সৌন্দর্য বাড়াত না, কংক্রিটের দীর্ঘ পথকে দিত ছায়া, শীতলতা ও সুশৃঙ্খল রূপ। নান্দনিকতার বাইরেও ছিল তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
কিন্তু এখন সেই তালগাছগুলোর অনেকটির মাথা কাটা, ডালপালা ছেঁটে ফেলা। হঠাৎ করে বদলে যাওয়া এই চিত্র দেখে স্থানীয় মানুষ ও পরিবেশকর্মীরা আশঙ্কা করছেন, কয়েক দশক ধরে গড়ে ওঠা একটি প্রাকৃতিক সুরক্ষা বলয় ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
উত্তরাঞ্চল বিদ্যুৎ সরবরাহ কোম্পানি লিমিটেডের উদ্যোগে প্রায় ৭৫০টি তালগাছের ডাল ও শীর্ষাংশ কাটার ঘটনায় ক্ষোভ ছড়িয়েছে স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবেশবাদীদের মধ্যে। তাদের অভিযোগ, কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই এবং পরিবেশগত প্রভাব বিবেচনা না করেই এই কাজ করা হয়েছে।
স্থানীয়দের উদ্যোগে গড়ে ওঠা সবুজ করিডর
রামভদ্রপুর থেকে বাট্টালি বোয়ালিয়া পর্যন্ত বাইপাস সড়কের পাশে গ্রামের মানুষরা বছরের পর বছর ধরে আশপাশ থেকে সংগ্রহ করা বীজ দিয়ে তালগাছ রোপণ করেছিলেন। বর্তমানে এসব গাছের বয়স প্রায় ২০ থেকে ৩০ বছর।
সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রায় দুই কিলোমিটার দীর্ঘ এই অংশটি পরিণত হয় সবুজ ও শীতল এক করিডরে। একঘেয়ে সড়কপথে এনে দেয় বৈচিত্র্য, একই সঙ্গে বজ্রপাত থেকে সুরক্ষা দেয়—যা বাংলাদেশে তালগাছের একটি পরিচিত উপকারিতা।
কিন্তু বিদ্যুতের খুঁটি ও উপর দিয়ে যাওয়া তারের সুবিধার জন্য সাম্প্রতিক সময়ে ডাল কাটা ও মাথা ছাঁটার ফলে পুরো এলাকার চেহারা বদলে গেছে।

ক্ষতির আশঙ্কা ও স্থানীয়দের উদ্বেগ
সম্প্রতি এলাকায় গিয়ে ইউএনবি প্রতিবেদক দেখেন, সড়কের পাশে হাজারের বেশি তালগাছ থাকলেও এর মধ্যে প্রায় ৭৫০টির অবস্থা দৃশ্যমানভাবে পরিবর্তিত। অনেক গাছ দুর্বল হয়ে পড়েছে। স্থানীয়দের আশঙ্কা, এই ক্ষতি আর ফিরিয়ে নেওয়া যাবে না।
স্থানীয় বাসিন্দা সাখাওয়াত হোসেন বলেন, তালগাছের মাথা কেটে দেওয়া বিদ্যুৎ অফিসের কর্মীদের ঠিক হয়নি। আগেও এভাবে কাজ করার পর কিছু গাছ মরে গেছে। তখন প্রতিবাদ করলেও কেউ শোনেনি।
আরেক বাসিন্দা বেলাল হোসেন বলেন, একটি তালগাছ বড় হতে কয়েক দশক লাগে। অথচ বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজন একদিনেই ডাল কেটে মাথা ছেঁটে দিল। খুঁটি সামান্য সরালেই গাছগুলো বাঁচানো যেত, কিন্তু তা না করে ইচ্ছাকৃতভাবেই ক্ষতি করা হয়েছে।
পরিবেশগত ঝুঁকির সতর্কবার্তা
পরিবেশকর্মীরা বলছেন, বিষয়টি শুধু স্থানীয় ভোগান্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। নওগাঁর পরিবেশকর্মী নাইস পারভীন জানান, তালগাছ কাটার ফলে এলাকায় বজ্রপাতজনিত ঝুঁকি বাড়তে পারে।
তার মতে, বজ্রপাত থেকে মানুষের জীবন রক্ষায় তালগাছ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে সরকার গাছ লাগানোর কথা বলছে, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো বড় ও পরিণত গাছ ধ্বংস করছে। এভাবে চলতে থাকলে গাছ রক্ষার আন্দোলনে নামতে বাধ্য হবেন তারা।
নেস্কোর ব্যাখ্যা
সমালোচনার মুখে নেস্কো কর্তৃপক্ষ আত্মপক্ষ সমর্থন করেছে। নেস্কো দক্ষিণ অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মিলন মাহমুদ জানান, এটি নিয়মিত ও প্রয়োজনীয় কাজ।
তার ভাষ্য, ৩৩ হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ লাইনের নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ গাছের ডাল ও শীর্ষাংশ কাটা হয়েছে। ঝড়ের সময় গাছের সঙ্গে তারের সংস্পর্শ হলে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই প্রতি বছরই এ ধরনের কাজ করা হয়।
তবে স্থানীয়দের দাবি, নিরাপত্তা ও পরিবেশ সংরক্ষণ একে অপরের বিরোধী হতে পারে না। তাদের মতে, খুঁটি স্থানান্তর বা উন্নত প্রযুক্তির তার ব্যবহার করলে বিদ্যুৎ সরবরাহও বজায় থাকত, আবার তালগাছগুলোকেও বাঁচানো যেত।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















