বিয়ের কথা উঠলেই যে রোমান্স, স্বপ্ন আর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ছবি ভেসে ওঠে, সেখানে এখন আরেকটি প্রশ্নও নীরবে ঢুকে পড়ছে। বিয়ের আগে কি আর্থিক চুক্তি করা হবে। একসময় যে বিষয়টি ধনী কিংবা তারকা দম্পতিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, আজ তা তরুণ প্রজন্মের কাছে প্রায় স্বাভাবিক আলোচনার অংশ হয়ে উঠেছে।
সাম্প্রতিক একাধিক জরিপ ও গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, মিলেনিয়াল ও জেন জি প্রজন্মের বড় একটি অংশ বিয়ের আগে প্রেনাপ বা বিবাহ-পূর্ব আর্থিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করছে। যুক্তরাষ্ট্রে এই প্রবণতা বিশেষভাবে চোখে পড়ছে, যেখানে এক দশকের ব্যবধানে প্রেনাপে আগ্রহ কয়েক গুণ বেড়েছে। তরুণদের কাছে এটি আর অবিশ্বাসের প্রতীক নয়, বরং ভবিষ্যতের ঝুঁকি সামাল দেওয়ার এক ধরনের আর্থিক সতর্কতা।
প্রেমের সঙ্গে হিসাবের সহাবস্থান
লস অ্যাঞ্জেলেসের এক তরুণ দম্পতির গল্প এই পরিবর্তনের প্রতীক। প্রেম, বাগদান এবং বিয়ের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গে তারা আগেই ঠিক করে ফেলেছিলেন, ভবিষ্যতে কেউ সাফল্য পেলে তার সৃষ্ট সম্পদের মালিকানা কীভাবে নির্ধারিত হবে। ভালোবাসার জায়গায় কোনো ফাঁক না রেখেই তারা বেছে নিয়েছেন লিখিত স্পষ্টতা। এই মানসিকতাই এখন অনেক তরুণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে।
বিবাহের আগে সম্পদ, ঋণ, পেশাগত সাফল্য কিংবা সম্ভাব্য বিচ্ছেদের কথা ভাবা আগে অশুভ বলে মনে করা হতো। কিন্তু এখন তরুণদের বড় অংশই মনে করছে, স্পষ্ট চুক্তি বরং সম্পর্ককে নিরাপদ করে।
ডিজিটাল যুগে প্রেনাপ সহজলভ্য
এই প্রবণতাকে আরও ত্বরান্বিত করেছে প্রযুক্তি। অনলাইনভিত্তিক বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম ও অ্যাপ এখন প্রেনাপ তৈরির প্রক্রিয়াকে সহজ করে দিয়েছে। আইনজীবীর চেম্বারে না গিয়ে ঘরে বসেই প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে চুক্তির খসড়া তৈরি করা যাচ্ছে। কোথাও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তায় দম্পতিদের আর্থিক আলোচনাও করানো হচ্ছে।

এই চুক্তিগুলোতে এখন শুধু সম্পদ ভাগাভাগির বিষয়ই নয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিচ্ছেদের পর আচরণ, সন্তান ধারণ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত কিংবা ভবিষ্যৎ বিনিয়োগের দিকনির্দেশনাও যুক্ত হচ্ছে। ফলে প্রেনাপ ধীরে ধীরে আধুনিক দাম্পত্য জীবনের এক ধরনের নীতিমালায় পরিণত হচ্ছে।
কেন এত আগ্রহ তরুণদের
বিশেষজ্ঞদের মতে, এর পেছনে আছে কয়েকটি বাস্তব কারণ। বর্তমান প্রজন্ম বড় হয়েছে বিচ্ছেদ, পারিবারিক ভাঙন আর আর্থিক অনিশ্চয়তার মধ্যে। শিক্ষাঋণের বোঝা, চাকরির অনিশ্চয়তা আর দ্রুত বদলে যাওয়া কাজের ধরন তাদের আগেই সতর্ক করে তুলেছে। ফলে বিয়েকেও তারা দেখছে এক ধরনের আর্থিক অংশীদারিত্ব হিসেবে।
অনেক নারীর কাছে প্রেনাপ এখন নিজের অর্থনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করার হাতিয়ার। আবার কেউ কেউ মনে করছেন, ভবিষ্যতে আইনি লড়াইয়ের ঝামেলা কমানোর উপায় হিসেবেই এটি কার্যকর।
ভালোবাসা কি তাতে ক্ষতিগ্রস্ত
তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, এত হিসাবনিকাশ কি সম্পর্কের আবেগ নষ্ট করে দেয়। আইনজীবী ও সমাজ বিশ্লেষকদের মতে, প্রেনাপ কখনোই ভাঙা হৃদয় বা মানসিক ক্ষতি ঠেকাতে পারে না। চুক্তি যতই বিস্তারিত হোক, সম্পর্কের অনুভূতিগত টানাপোড়েন তার বাইরে থেকেই যায়।
তবু অনেকের মতে, বিয়ের আগে এই আলোচনা নিজেই এক ধরনের পরীক্ষা। ভবিষ্যৎ সঙ্গী কীভাবে অর্থ, দায়িত্ব আর ভাগাভাগিকে দেখছে, তা স্পষ্ট হয়ে যায় এই কথোপকথনে।
নতুন প্রজন্মের দাম্পত্য দর্শন
এক সময় বিয়ে মানেই ছিল আজীবনের অঙ্গীকার। এখন তা অনেকের কাছে সমান অংশীদারিত্বের এক চুক্তি, যেখানে ভালোবাসার পাশাপাশি বাস্তবতার হিসাবও সমান গুরুত্বপূর্ণ। প্রেনাপের জনপ্রিয়তা সেই বদলে যাওয়া দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন।
বিয়ে যে কেবল আবেগের বিষয় নয়, বরং জীবনের বড় আর্থিক সিদ্ধান্তও—এই উপলব্ধি নিয়েই এগোচ্ছে নতুন প্রজন্ম। প্রেনাপ সেই বাস্তবতারই লিখিত দলিল।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















