২০২৫ সালে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি ছিল চরম উদ্বেগজনক। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বছরজুড়ে মব সন্ত্রাসে অন্তত ১৯৭ জন মানুষ নিহত হয়েছেন, রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন ১০২ জন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ৩৮ জন এবং কারা হেফাজতে মারা গেছেন অন্তত ১০৭ জন। এই পরিসংখ্যানগুলো দেখায়, রাজনৈতিক পরিবর্তন ও সংস্কারের ঘোষণা থাকা সত্ত্বেও নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা ও মানবাধিকারের বাস্তব পরিস্থিতিতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটেনি।
রাষ্ট্রীয় পরিবর্তন ও মানবাধিকারের বাস্তবতা
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আগের সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয় এবং সংস্কার ও গণতান্ত্রিক উত্তরণের প্রতিশ্রুতি দেয়। মানবাধিকার কমিশন সংস্কার, গুম প্রতিরোধ ও বিচারব্যবস্থার উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাস্তব পর্যায়ে দমন-পীড়ন, সহিংসতা ও বৈষম্যের চিত্র অব্যাহত থাকে।
মব সন্ত্রাসে ১৯৭ জনের মৃত্যু, আইনের শাসনের সংকট
২০২৫ সালে মব সন্ত্রাস সবচেয়ে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের রূপ নেয়। গুজব, সন্দেহ ও ধর্মীয় উগ্রতার নামে বিচারবহির্ভূতভাবে মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। নারী, শ্রমজীবী মানুষ, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বাউল সম্প্রদায়ের সদস্য ও ভিন্নমতাবলম্বীরা এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অনেক ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করেছে।

রাজনৈতিক সহিংসতায় ১০২ মৃত্যু, আহত হাজারো
বছরজুড়ে রাজনৈতিক সহিংসতায় অন্তত ১০২ জন নিহত এবং কয়েক হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। দলীয় সংঘর্ষ, অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও নির্বাচনী প্রেক্ষাপটে সহিংস হামলা দেশের সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে নাজুক করে তোলে এবং নাগরিকদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও হেফাজতে মৃত্যু
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে কথিত বন্দুকযুদ্ধ, হেফাজতে নির্যাতন ও গুলির ঘটনায় কমপক্ষে ৩৮ জন নিহত হয়েছেন। পাশাপাশি কারা হেফাজতে অন্তত ১০৭ জনের মৃত্যু ঘটেছে, যা চিকিৎসা অবহেলা, অমানবিক আচরণ ও জবাবদিহির অভাবকে স্পষ্টভাবে সামনে এনেছে।
জাতীয় স্মৃতি ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা
বছরজুড়ে মুক্তিযুদ্ধ ও জাতিসত্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ভাস্কর্য, স্মৃতিস্তম্ভ ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ভাঙচুর চালানো হয়। বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে একাধিকবার হামলার ঘটনা জাতীয় ইতিহাস ও স্বাধীনতার স্মৃতিচিহ্নের প্রতি গভীর অবমাননার প্রতীক হয়ে ওঠে।

ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও নারীর ওপর সহিংসতা
২০২৫ সালে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর একাধিক হামলায় অন্তত একজন নিহত ও বহু মানুষ আহত হন। একই সময়ে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা ভয়াবহ মাত্রা নেয়। ধর্ষণের ঘটনা ঘটে ৭৪৯টি, যার মধ্যে ১৮০টি ছিল দলবদ্ধ ধর্ষণ। ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যা, আত্মহত্যা ও পারিবারিক সহিংসতা নারীদের জীবনকে আরও অনিরাপদ করে তোলে।
সামগ্রিক মূল্যায়ন
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৫ সালে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি সামগ্রিকভাবে অবনতি ঘটেছে। মব সন্ত্রাস, রাজনৈতিক সহিংসতা, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও কারা হেফাজতে মৃত্যুর উচ্চ সংখ্যা প্রমাণ করে যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পরিবর্তন হলেও মানবাধিকারের সুরক্ষা এখনো বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে রয়ে গেছে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















