০৭:০৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ৬২ তম কিস্তি )

  • Sarakhon Report
  • ১২:০০:০৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৯ মে ২০২৪
  • 16
রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যে আরেকটি নতুন যুগ সৃষ্টি হয়েছিলো। ভাষাকে মানুষের মুখের ভাষার কাছে নিয়ে আসা নয়, সাহিত্যে’র বিষয়ও হয়েছিলো অনেক বিস্তৃত। সাহিত্যে উঠে এসেছিলো পরিবর্তিত মন ও সমাজের নানান প্রাঙ্গন। সময়ের পথ ধরে সে যুগটি এখন নিকট অতীত। আর সে সাহিত্যও চিরায়ত সাহিত্য। দূর অতীত ও নিকট অতীতের সকল চিরায়ত সাহিত্য মানুষকে সব সময়ই পরিপূর্ণ মানুষ হতে সাহায্য করে। চিরায়ত সাহিত্যকে জানা ছাড়া বাস্তবে মানুষ তার নিজেকে সম্পূর্ণ জানতে পারে না।

সারাক্ষণের চিরায়ত সাহিত্য বিভাগে এবারে থাকছে মানিক বন্দোপধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য।

দিবারাত্রির কাব্যে’র ভূমিকায় মানিক বন্দোপধ্যায় নিজেই যা লিখেছিলেন …..

দিবারাত্রির কাব্য আমার একুশ বছর বয়সের রচনা। শুধু প্রেমকে ভিত্তি করে বই লেখার সাহস ওই বয়সেই থাকে। কয়েক বছর তাকে তোলা ছিল। অনেক পরিবর্তন করে গত বছর বঙ্গশ্রীতে প্রকাশ করি।

দিবারাত্রির কাব্য পড়তে বসে যদি কখনো মনে হয় বইখানা খাপছাড়া, অস্বাভাবিক,- তখন মনে রাখতে হবে এটি গল্পও নয় উপন্যাসও নয়, রূপক কাহিনী। রূপকের এ একটা নূতন রূপ। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতগুলি অনুভূতি যা দাঁড়ায়, সেইগুলিকেই মানুষের রূপ দেওয়া হয়েছে। চরিত্রগুলি কেউ মানুষ নয়, মানুষের Projection-মানুষের এক এক টুকরো মানসিক অংশ।

দিবা রাত্রির কাব্য

মানিক বন্দোপাধ্যায়

 

হেরম্বের অভিজ্ঞতায় মালতী আজ প্রথম ধমক খেয়ে চুপ করে রইল। এতক্ষণে হেরম্বের মাথার মধ্যে ঝিঝিম্ করছে। এ আশ্রম অভিশপ্ত; মালতীর যুগব্যাপী অন্ধ অতৃপ্ত ক্ষুধায় এখানকার বাতাসও বিষাক্ত হয়ে আছে।

গভীর নিশিতে এখানে মালতীর সঙ্গে একঘরে জেগে থাকলে দু’দিনে মানুষ পাগল হয়ে যাবে।

অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে মালতী ডাকল, ‘আনন্দ, ঘুমুলি?’

আনন্দ সাড়া দিল না।

মালতী উঠে বসল। ‘হেরম্ব?’

‘জেগেই আছি।’

‘আমার বুকে আগুন জ্বলছে, হেরম্ব। আমি এখানে নিশ্বাস নিতে পারছি না। দম আটকে আসছে।’

‘একটু ধৈর্য না ধরলে

মালতী বাধা দিয়ে বলল, ‘কিছু ব’লো না, হেরম্ব। একবার ওঠ দিকি। শব্দ ক’রো না বাপু, মেয়ের ঘুম ভাঙিও না।’

মালতী উঠে দাঁড়াল। আনন্দের কাছে গিয়ে সে ঘুমন্ত মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইল পলকহীন চোখে। হেরম্ব উঠে এলে ফিসফিস করে বলল, ‘দেখ, মুখ ঢেকে ঘুমিয়েছে। ওকে না জাগিয়ে মুখ থেকে কাপড়টা সরাতে পার হেরম্ব? একবার মুখখানা দেখি।’

হেরম্ব সন্তর্পণে আনন্দের মুখ থেকে আঁচল সরিয়ে দিল। খানিকক্ষণ একদৃষ্টে আনন্দের মুখ দেখে হাত দিয়ে তার চিবুক দু’য়ে মালতী চুমো খেল। তারপর পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

থামল সে একেবারে বাড়ির বাইরে বাগানে। হেরম্ব তাকে অনুসরণ করল নীরবে।

মালতী আঁচল থেকে চাবি খুলে হেরম্বের হাতে দিল।

‘আমি চললাম, হেরম্ব।’

হেরম্ব শান্তকণ্ঠে বলল, ‘চলুন, আমিও যাচ্ছি।’

মালতী বলল, ‘তুমিও খেপলে নাকি? আনন্দ একা রইল, তুমিও যাচ্ছ! আনন্দের চেয়ে আমার জন্যই তোমার মায়া বুঝি উথলে উঠল?’

হেরম্ব বলল, ‘আপনার সম্বন্ধে আমার একটা দ্বায়িত্ব আছে। রাতদুপুরে আপনাকে আমি একা যেতে দিতে পারি না।’

মালতী বলল, ‘পাগলামি ক’রো না, হেরম্ব। প্রথম বয়সে একবার রাতদুপুরে ঘর ছেড়েছিলাম, মা-বাবা ভাই-বোন কেউ ঠেকাতে পারেনি, পোড় খেয়ে খেয়ে এখন তো পেকে গেছি, তুমি আমাকে আটকাবে? শুধু যে নিজের জ্বালায় চলে যাচ্ছি তা ভেব না, হেরম্ব। আমার মতো মা কাছে থাকলে আনন্দ শান্তি পাবে না। আমার স্বভাব বড় মন্দ, হেরম্ব! নষ্ট করে দিয়েছে।’ আমি কারণ খাই, আমার মাথা খারাপ, তোমার মাস্টারমশাই আমাকে একেবারে নষ্ট করে দিয়েছে।

 

 

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ৬১ তম কিস্তি )

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ৬১ তম কিস্তি )

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ৬২ তম কিস্তি )

১২:০০:০৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৯ মে ২০২৪
রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যে আরেকটি নতুন যুগ সৃষ্টি হয়েছিলো। ভাষাকে মানুষের মুখের ভাষার কাছে নিয়ে আসা নয়, সাহিত্যে’র বিষয়ও হয়েছিলো অনেক বিস্তৃত। সাহিত্যে উঠে এসেছিলো পরিবর্তিত মন ও সমাজের নানান প্রাঙ্গন। সময়ের পথ ধরে সে যুগটি এখন নিকট অতীত। আর সে সাহিত্যও চিরায়ত সাহিত্য। দূর অতীত ও নিকট অতীতের সকল চিরায়ত সাহিত্য মানুষকে সব সময়ই পরিপূর্ণ মানুষ হতে সাহায্য করে। চিরায়ত সাহিত্যকে জানা ছাড়া বাস্তবে মানুষ তার নিজেকে সম্পূর্ণ জানতে পারে না।

সারাক্ষণের চিরায়ত সাহিত্য বিভাগে এবারে থাকছে মানিক বন্দোপধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য।

দিবারাত্রির কাব্যে’র ভূমিকায় মানিক বন্দোপধ্যায় নিজেই যা লিখেছিলেন …..

দিবারাত্রির কাব্য আমার একুশ বছর বয়সের রচনা। শুধু প্রেমকে ভিত্তি করে বই লেখার সাহস ওই বয়সেই থাকে। কয়েক বছর তাকে তোলা ছিল। অনেক পরিবর্তন করে গত বছর বঙ্গশ্রীতে প্রকাশ করি।

দিবারাত্রির কাব্য পড়তে বসে যদি কখনো মনে হয় বইখানা খাপছাড়া, অস্বাভাবিক,- তখন মনে রাখতে হবে এটি গল্পও নয় উপন্যাসও নয়, রূপক কাহিনী। রূপকের এ একটা নূতন রূপ। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতগুলি অনুভূতি যা দাঁড়ায়, সেইগুলিকেই মানুষের রূপ দেওয়া হয়েছে। চরিত্রগুলি কেউ মানুষ নয়, মানুষের Projection-মানুষের এক এক টুকরো মানসিক অংশ।

দিবা রাত্রির কাব্য

মানিক বন্দোপাধ্যায়

 

হেরম্বের অভিজ্ঞতায় মালতী আজ প্রথম ধমক খেয়ে চুপ করে রইল। এতক্ষণে হেরম্বের মাথার মধ্যে ঝিঝিম্ করছে। এ আশ্রম অভিশপ্ত; মালতীর যুগব্যাপী অন্ধ অতৃপ্ত ক্ষুধায় এখানকার বাতাসও বিষাক্ত হয়ে আছে।

গভীর নিশিতে এখানে মালতীর সঙ্গে একঘরে জেগে থাকলে দু’দিনে মানুষ পাগল হয়ে যাবে।

অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে মালতী ডাকল, ‘আনন্দ, ঘুমুলি?’

আনন্দ সাড়া দিল না।

মালতী উঠে বসল। ‘হেরম্ব?’

‘জেগেই আছি।’

‘আমার বুকে আগুন জ্বলছে, হেরম্ব। আমি এখানে নিশ্বাস নিতে পারছি না। দম আটকে আসছে।’

‘একটু ধৈর্য না ধরলে

মালতী বাধা দিয়ে বলল, ‘কিছু ব’লো না, হেরম্ব। একবার ওঠ দিকি। শব্দ ক’রো না বাপু, মেয়ের ঘুম ভাঙিও না।’

মালতী উঠে দাঁড়াল। আনন্দের কাছে গিয়ে সে ঘুমন্ত মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইল পলকহীন চোখে। হেরম্ব উঠে এলে ফিসফিস করে বলল, ‘দেখ, মুখ ঢেকে ঘুমিয়েছে। ওকে না জাগিয়ে মুখ থেকে কাপড়টা সরাতে পার হেরম্ব? একবার মুখখানা দেখি।’

হেরম্ব সন্তর্পণে আনন্দের মুখ থেকে আঁচল সরিয়ে দিল। খানিকক্ষণ একদৃষ্টে আনন্দের মুখ দেখে হাত দিয়ে তার চিবুক দু’য়ে মালতী চুমো খেল। তারপর পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

থামল সে একেবারে বাড়ির বাইরে বাগানে। হেরম্ব তাকে অনুসরণ করল নীরবে।

মালতী আঁচল থেকে চাবি খুলে হেরম্বের হাতে দিল।

‘আমি চললাম, হেরম্ব।’

হেরম্ব শান্তকণ্ঠে বলল, ‘চলুন, আমিও যাচ্ছি।’

মালতী বলল, ‘তুমিও খেপলে নাকি? আনন্দ একা রইল, তুমিও যাচ্ছ! আনন্দের চেয়ে আমার জন্যই তোমার মায়া বুঝি উথলে উঠল?’

হেরম্ব বলল, ‘আপনার সম্বন্ধে আমার একটা দ্বায়িত্ব আছে। রাতদুপুরে আপনাকে আমি একা যেতে দিতে পারি না।’

মালতী বলল, ‘পাগলামি ক’রো না, হেরম্ব। প্রথম বয়সে একবার রাতদুপুরে ঘর ছেড়েছিলাম, মা-বাবা ভাই-বোন কেউ ঠেকাতে পারেনি, পোড় খেয়ে খেয়ে এখন তো পেকে গেছি, তুমি আমাকে আটকাবে? শুধু যে নিজের জ্বালায় চলে যাচ্ছি তা ভেব না, হেরম্ব। আমার মতো মা কাছে থাকলে আনন্দ শান্তি পাবে না। আমার স্বভাব বড় মন্দ, হেরম্ব! নষ্ট করে দিয়েছে।’ আমি কারণ খাই, আমার মাথা খারাপ, তোমার মাস্টারমশাই আমাকে একেবারে নষ্ট করে দিয়েছে।

 

 

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ৬১ তম কিস্তি )

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ৬১ তম কিস্তি )