মাহমুদুল হককে বাদ দিয়ে বাংলা উপন্যাসকে ভাবা ভুল হবে। বাংলাদেশে কেন মাহমুদুল হক বহু পঠিত নয় বা তাঁকে নিয়ে কম আলোচনা হয় এ সত্যিই এক প্রশ্ন।
মাহমুদুল হকের সাহিত্য নিসন্দেহে স্থান নিয়েছে চিরায়ত সাহিত্যের সারিতে।
তার উপন্যাস জীবন আমার বোন শুধু সময়ের চিত্র নয়, ইতিহাসকে গল্পের মধ্যে দিয়ে আনা নয় সেখানে রয়ে গেছে আরো অনেক কিছু।
তরুণ প্রজম্মের পাঠকের কাজে তাই তুলে দেয়া হলো মাহমুদুল হকের এই অনবদ্য উপন্যাস জীবন আমার বোন। আর আগের প্রজম্ম নিশ্চয়ই নতুন করে আরেকবার গ্রহন করুক এক অমৃত সাহিত্য। – সম্পাদক
মতিঝিলে সেজখালার ওখানে আগে প্রায়ই ঘোঁটা কাটতো খোকা; সেজখালার কাছে তারা বড় আদরের পাত্র। সেজখালার ওখানে গেলেই মা’র কথা শুনতে হয় খোকাকে; অনেক সময় তার ভালোলাগে না, একঘেয়ে মনে হয়, তবু শুনতে হয়। কি ভালবাসতো, কবে কি কথা নিয়ে রাগারাগি হয়েছিলো, কিভাবে দু’হাতে সব বিলিয়ে দেবার অভ্যেস ছিলো, রাজ্যির সব বৃত্তান্ত। বিয়ের পরও মা রেডিয়োতে গান গাইত, খ্যাতি অর্জন করেছিলো প্রচুর; তখনকার দিনে কোনো রেকর্ড কোম্পানী ছিলো না ব’লে আপসোসের আর শেষ নেই সেজখালার।
এখন আর সহজে ও পথ মাড়ায় না খোকা। বেলী বড় হবার পর থেকে সেজখালার বাড়ি মাড়ানো এক রকম ছেড়ে দিয়েছে খোকা। মা’র স্মৃতি, যা অতিদ্রুত তার কাছে ঝাপসা এবং ধূসর হ’য়ে গিয়েছে, বারবার একই সুরে তা নাড়াচাড়া করতে তার ভালো লাগে না। যা নেই কিংবা যা কখনো হবে না, তা নিয়ে অযথা মাথা কোটাকুটি করাটাও তার কাছে এক ধরনের গ্রাম্যতা, এইসব ফাঁপা হা-হুতাশে সে পচা বাঁশপাতার গন্ধ পায়। সেজখালা একটা রোগের মতো এইসব হা-হুতাশ নিজের ভিতর পুষে রেখেছে।
বাইরে থেকে দেখলে একটি অতি সাধারণ মেয়ে বেলী, যার বয়েস পনেরো থেকে ষোলো। লেখাপড়ায় মাঝামাঝি, ফি-বার ক্লাসে ওঠে, স্কুলের ফাংশনে মণিপুরী নাচ নাচে, ফেব্রুয়ারির বিশ তারিখে ছোট ভাইবোনদের ফুল চুরিতে উৎসাহিত করে, একুশে ফেব্রুয়ারি ভোরবেলা বাসন্তী রঙের লালপেড়ে শাড়ি প’রে শহীদ মিনারে যায়, চলনে-বলনে সুন্দর, সুশ্রী; কিন্তু পরিবারের ভিতর থেকে খোকা দেখতে পেল এমন অনেক কিছুই করে বেলী যা বাইরে থেকে ধরা পড়ে না। দেদার চিঠি লেখে সে সিনেমা ম্যাগাজিনের প্রশ্নোত্তর বিভাগে, নীহারগুপ্তের বই পড়ে আর দাগ মারে, নিজে পয়সা চুরি ক’রে ছোটদের কাঁধে দোষ চাপিয়ে মার খাওয়ায়, এবং সেই পয়সায় ন্যূমার্কেটে শপিং করে, লিপস্টিক কেনে।
এই বয়েসেই লিপস্টিকের তুখোড় সমঝদার ব’নে গেছে বেলী। পড়ার টেবিলের ডয়ারটা তার গুদামঘর। গুদাম বোঝাই হানি-ইন- গোল্ড, টিজিং পিঙ্ক, কফি ক্যারামেল–গুচ্ছের শেডের লিপস্টিক। ফরাসী সেন্ট আর মেকাপের সামগ্রীও তার সংগ্রহে কম নেই। তলে তলে একাধিক ছেলের সঙ্গে চুটিয়ে প্রেমও করে, অর্থাৎ ইচ্ছেমতো বাঁদর নাচ নাচায়।
যারা তার সঙ্গে প্রেম করে তাদের কেউ চিকন মোড়ের পায়জামা আর ঢিলে পাঞ্জাবি পরে। শ্রীযুক্ত চারুদত্ত আধারকারের জীবন থেকে ঝেড়ে কোটেশান দিয়ে প্রেমপত্র লেখে। পিছনে হাত বেঁধে আড়চোখে ঠারেঠোরে চায় আর হরদম বাড়ির সামনে পায়চারি করে, এরই নাম নাকি ফিলডিং মারা। একটা ভোগেল, খোকা মনে মনে উচ্চারণ করে।
একজন আছে যে প্রায়ই রেসিং সাইকেলে চেপে বাড়ির সামনে রুটিন ক’রে টহল মারে। সাইকেলের উপর ঊর্ধ্বকমার মতো কুঁজো হ’য়ে দুমড়ে প’ড়ে আপনমনে ফিক ফিক ক’রে হাসতে থাকে ছেলেটি। বাড়ির সামনে এলেই কায়দা মেরে দু’হাত ছেড়ে দেয় সে, তারপর উপরমুখো হ’য়ে বাঁইবাই ক’রে চালানো শুরু করে। এই সময় তার ঠোঁটে মাষ- কলাইয়ের ডালের এঁটোর মতো যে হাসিটি লেগে থাকে, তা দেখে মনে হয় কলোনীর এক হাজার ডবকা মেয়ে নিজেদের ভিতর চুলোচুলি ক’রে ওর দু’গালে চুমু খেয়ে যাচ্ছে। নির্ঘাত ছিট আছে ছোকরার মাথায়, খোকার মনে হ’লো।
Leave a Reply