০১:২১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫

জীবন আমার বোন (পর্ব-৬৪)

  • Sarakhon Report
  • ১২:০০:০২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ জুলাই ২০২৪
  • 18

মাহমুদুল হককে বাদ দিয়ে বাংলা উপন্যাসকে ভাবা ভুল হবে। বাংলাদেশে কেন মাহমুদুল হক বহু পঠিত নয় বা তাঁকে নিয়ে কম আলোচনা হয় এ সত্যিই এক প্রশ্ন। 

মাহমুদুল হকের সাহিত্য নিসন্দেহে স্থান নিয়েছে চিরায়ত সাহিত্যের সারিতে। 

তার উপন্যাস জীবন আমার বোন শুধু সময়ের চিত্র নয়, ইতিহাসকে গল্পের মধ্যে দিয়ে আনা নয় সেখানে রয়ে গেছে আরো অনেক কিছু। 

তরুণ প্রজম্মের পাঠকের কাজে তাই তুলে দেয়া হলো মাহমুদুল হকের এই অনবদ্য উপন্যাস জীবন আমার বোন। আর আগের প্রজম্ম নিশ্চয়ই নতুন করে আরেকবার গ্রহন করুক এক অমৃত সাহিত্য। – সম্পাদক

মাহমুদুল হক

‘হিটলারের সেই রাইখস্ট্যাগ জ্বালিয়ে দেবার কথা মনে আছে, নিজেকে ভরাডুবি থেকে রক্ষা করার জন্যে এটা তার পক্ষে অপরিহার্য হ’য়ে পড়েছিলো সেদিন।’ একটু থেমে মুরাদ বললে, ‘যেসব দুর্ঘটনা ঘটছে তার সবকিছুর পিছনে একটা অদৃশ্য লোমশ হাত রয়েছে, যে হাতে মদ আর বারুদের গন্ধ। লুটপাট আর আগুন ঠেকাতে গিয়ে আমি কম লোকের মাথা ফাটতে দেখিনি। এখন এমন একজনও মানুষ পাবি না সে ছেলেই হোক বুড়োই হোক শ্রমিক হোক, যাই হোক না কেন, যে সজাগ নয়, সতর্ক নয়। তুইই বল না, এদেশের মানুষের এত তাড়াতাড়ি আর এমন সর্বগ্রাসীভাবে আত্মোপলব্ধি ঘটবে তুই নিজেও কি কখনো ভাবতে পেরেছিলি? এর আগে আর কখনো আমরা এমনভাবে একাত্মতা অনুভব করিনি।
সারা দেশের মানুষ আশ্চর্যভাবে এক হ’য়ে গিয়েছে। যারা ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চায় তাদের প্রয়োজন হ’য়ে পড়েছে একতার এই দুর্ভেদ্য দুর্গটিকে গুঁড়িয়ে দেবার। ওরা সবসময় এমন সব বানোয়াট পরিস্থিতি তৈরি করতে সচেষ্ট থাকবে যা ওদের আঘাত হানার জঘন্য ব্যাপারটাকে যৌক্তিক ক’রে তুলতে সাহায্য করবে। একটা বছর ধ’রে এই যে সমানে ‘ইয়াহিয়া ইয়াহিয়া-সাবধান সাবধান’-এর স্রোত চলছে এটা যে নিছক একটা শ্লোগান নয়, ওরা তা খুব ভালো ক’রেই জানে। যেমন বুনো ওল তেমনি বাঘা তেঁতুল, এই আর কি; কেবলমাত্র নিজেদের তৈরি ক’রে নিতে যে সময়টুকু লাগে। সময় আর সুযোগ অনুকূলে এলেই হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে।’
ইয়াসিন বললে, ‘আসলে আমাদের চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছে। যার মুখে যা শুনছি, তাই বলছি
খোকা নিস্পৃহকণ্ঠে মুরাদকে জিগ্যেশ করলে, ‘ধর সব দাবি যদি মেনে নেয়?’
‘নিতেই পারে না’ জোর দিয়ে মুরাদ বললে, ‘বললাম না, সব ঘটনার মুখ একই দিকে। এতদিনের অভিজ্ঞতা থেকে তোর কি মনে হয় যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার মতো হিশেবী বুদ্ধি ওদের মাথায় ছিটেফোঁটাও আছে? রাজনীতির নামে এতদিন প্রাসাদের অন্ধকারে ষড়যন্ত্র চালিয়ে নিজেদের মগজে যা ছিলো তাও গাবিয়ে ফেলেছে; দেশীয় কুইসলিংরাও চোখে সর্ষেফুল দেখতে শুরু করেছে। আমি ব’লে রাখলাম, তুই দেখে নিস, সব শালার পতন হবে, কোনো শালা টিকবে না। এ হ’লো বর্ণমালার ইন্দ্রজাল।
আয়ুব খান থেকে এর শুরু, আমরা যাকে বলি সামরিক শাসন, কখনো নির্বাচনের মুখোশ এঁটে, কখনো গামছা ফেলে একেবারে বাবা আদমের মতো ন্যাংটো হ’য়ে। কিন্তু মেয়াদ ফুরিয়ে এসেছে। এ থেকে যে ভূতুড়ে যজ্ঞের শুরু তা ওয়াই-তে এসে ঠেকেছে, এরপর জেড, চীনা জুতার সুখতলা জুলফিকার আলী, ব্যাস্, তোর ওই খেল খতম, পয়সা হজম, এই-ই গানের বই গানের বই!’
খোকা কোনো কথা বললো না। চুপচাপ তাকিয়ে রইলো ঘনায়মান অন্ধকারের দিকে।
পানির উপরে হাওয়ার নাচন শুরু হয়েছে। বাংলা কবিতার একটি বিড়াল অন্ধকারকে ছোট ছোট বলের মতো থাবা দিয়ে লুকিয়ে আনছে, ছড়িয়ে দিচ্ছে, আর ‘চল নামি আষাঢ় আসিয়াছে’ ধরনের ঝাঁপ দিয়ে উদ্যানের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত ছোটাছুটি ক’রে নৃত্যরত জিপসী তা কুড়িয়ে নিচ্ছে, যেন শিলকুডুনি শৈশব। শৈশব জীবনে বারবার আসে না কেন? আসলে জীবন মানেই শৈশব; জীবনভর মানুষ এই একটা ঐশ্বর্যই ভাঙিয়ে খায়, আর কোনো পুঁজিপাট্টা নেই তার। এই এক অদ্ভুত জীবন, ধাপে ধাপে এরা নিজেদের ছোট ক’রে তোলে, রক্তে মিশে আছে এদের নিজেদের পতন।
ইয়াসিনও এক সময় উঠে দাঁড়ালো। বললে, ‘মধ্যে থেকে আমার বিয়েটা পিছিয়ে গেল, গুলি মারি শালার আন্দোলনে। দেশের লোক আর সময় পেলো না ম্যান্ডেট দেবার, চলি!’
জনপ্রিয় সংবাদ

জীবন আমার বোন (পর্ব-৬৪)

১২:০০:০২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ জুলাই ২০২৪

মাহমুদুল হককে বাদ দিয়ে বাংলা উপন্যাসকে ভাবা ভুল হবে। বাংলাদেশে কেন মাহমুদুল হক বহু পঠিত নয় বা তাঁকে নিয়ে কম আলোচনা হয় এ সত্যিই এক প্রশ্ন। 

মাহমুদুল হকের সাহিত্য নিসন্দেহে স্থান নিয়েছে চিরায়ত সাহিত্যের সারিতে। 

তার উপন্যাস জীবন আমার বোন শুধু সময়ের চিত্র নয়, ইতিহাসকে গল্পের মধ্যে দিয়ে আনা নয় সেখানে রয়ে গেছে আরো অনেক কিছু। 

তরুণ প্রজম্মের পাঠকের কাজে তাই তুলে দেয়া হলো মাহমুদুল হকের এই অনবদ্য উপন্যাস জীবন আমার বোন। আর আগের প্রজম্ম নিশ্চয়ই নতুন করে আরেকবার গ্রহন করুক এক অমৃত সাহিত্য। – সম্পাদক

মাহমুদুল হক

‘হিটলারের সেই রাইখস্ট্যাগ জ্বালিয়ে দেবার কথা মনে আছে, নিজেকে ভরাডুবি থেকে রক্ষা করার জন্যে এটা তার পক্ষে অপরিহার্য হ’য়ে পড়েছিলো সেদিন।’ একটু থেমে মুরাদ বললে, ‘যেসব দুর্ঘটনা ঘটছে তার সবকিছুর পিছনে একটা অদৃশ্য লোমশ হাত রয়েছে, যে হাতে মদ আর বারুদের গন্ধ। লুটপাট আর আগুন ঠেকাতে গিয়ে আমি কম লোকের মাথা ফাটতে দেখিনি। এখন এমন একজনও মানুষ পাবি না সে ছেলেই হোক বুড়োই হোক শ্রমিক হোক, যাই হোক না কেন, যে সজাগ নয়, সতর্ক নয়। তুইই বল না, এদেশের মানুষের এত তাড়াতাড়ি আর এমন সর্বগ্রাসীভাবে আত্মোপলব্ধি ঘটবে তুই নিজেও কি কখনো ভাবতে পেরেছিলি? এর আগে আর কখনো আমরা এমনভাবে একাত্মতা অনুভব করিনি।
সারা দেশের মানুষ আশ্চর্যভাবে এক হ’য়ে গিয়েছে। যারা ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চায় তাদের প্রয়োজন হ’য়ে পড়েছে একতার এই দুর্ভেদ্য দুর্গটিকে গুঁড়িয়ে দেবার। ওরা সবসময় এমন সব বানোয়াট পরিস্থিতি তৈরি করতে সচেষ্ট থাকবে যা ওদের আঘাত হানার জঘন্য ব্যাপারটাকে যৌক্তিক ক’রে তুলতে সাহায্য করবে। একটা বছর ধ’রে এই যে সমানে ‘ইয়াহিয়া ইয়াহিয়া-সাবধান সাবধান’-এর স্রোত চলছে এটা যে নিছক একটা শ্লোগান নয়, ওরা তা খুব ভালো ক’রেই জানে। যেমন বুনো ওল তেমনি বাঘা তেঁতুল, এই আর কি; কেবলমাত্র নিজেদের তৈরি ক’রে নিতে যে সময়টুকু লাগে। সময় আর সুযোগ অনুকূলে এলেই হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে।’
ইয়াসিন বললে, ‘আসলে আমাদের চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছে। যার মুখে যা শুনছি, তাই বলছি
খোকা নিস্পৃহকণ্ঠে মুরাদকে জিগ্যেশ করলে, ‘ধর সব দাবি যদি মেনে নেয়?’
‘নিতেই পারে না’ জোর দিয়ে মুরাদ বললে, ‘বললাম না, সব ঘটনার মুখ একই দিকে। এতদিনের অভিজ্ঞতা থেকে তোর কি মনে হয় যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার মতো হিশেবী বুদ্ধি ওদের মাথায় ছিটেফোঁটাও আছে? রাজনীতির নামে এতদিন প্রাসাদের অন্ধকারে ষড়যন্ত্র চালিয়ে নিজেদের মগজে যা ছিলো তাও গাবিয়ে ফেলেছে; দেশীয় কুইসলিংরাও চোখে সর্ষেফুল দেখতে শুরু করেছে। আমি ব’লে রাখলাম, তুই দেখে নিস, সব শালার পতন হবে, কোনো শালা টিকবে না। এ হ’লো বর্ণমালার ইন্দ্রজাল।
আয়ুব খান থেকে এর শুরু, আমরা যাকে বলি সামরিক শাসন, কখনো নির্বাচনের মুখোশ এঁটে, কখনো গামছা ফেলে একেবারে বাবা আদমের মতো ন্যাংটো হ’য়ে। কিন্তু মেয়াদ ফুরিয়ে এসেছে। এ থেকে যে ভূতুড়ে যজ্ঞের শুরু তা ওয়াই-তে এসে ঠেকেছে, এরপর জেড, চীনা জুতার সুখতলা জুলফিকার আলী, ব্যাস্, তোর ওই খেল খতম, পয়সা হজম, এই-ই গানের বই গানের বই!’
খোকা কোনো কথা বললো না। চুপচাপ তাকিয়ে রইলো ঘনায়মান অন্ধকারের দিকে।
পানির উপরে হাওয়ার নাচন শুরু হয়েছে। বাংলা কবিতার একটি বিড়াল অন্ধকারকে ছোট ছোট বলের মতো থাবা দিয়ে লুকিয়ে আনছে, ছড়িয়ে দিচ্ছে, আর ‘চল নামি আষাঢ় আসিয়াছে’ ধরনের ঝাঁপ দিয়ে উদ্যানের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত ছোটাছুটি ক’রে নৃত্যরত জিপসী তা কুড়িয়ে নিচ্ছে, যেন শিলকুডুনি শৈশব। শৈশব জীবনে বারবার আসে না কেন? আসলে জীবন মানেই শৈশব; জীবনভর মানুষ এই একটা ঐশ্বর্যই ভাঙিয়ে খায়, আর কোনো পুঁজিপাট্টা নেই তার। এই এক অদ্ভুত জীবন, ধাপে ধাপে এরা নিজেদের ছোট ক’রে তোলে, রক্তে মিশে আছে এদের নিজেদের পতন।
ইয়াসিনও এক সময় উঠে দাঁড়ালো। বললে, ‘মধ্যে থেকে আমার বিয়েটা পিছিয়ে গেল, গুলি মারি শালার আন্দোলনে। দেশের লোক আর সময় পেলো না ম্যান্ডেট দেবার, চলি!’