শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:৪৫ পূর্বাহ্ন

জীবন আমার বোন (পর্ব-৬৫)

  • Update Time : বুধবার, ৩১ জুলাই, ২০২৪, ১২.০০ পিএম

মাহমুদুল হককে বাদ দিয়ে বাংলা উপন্যাসকে ভাবা ভুল হবে। বাংলাদেশে কেন মাহমুদুল হক বহু পঠিত নয় বা তাঁকে নিয়ে কম আলোচনা হয় এ সত্যিই এক প্রশ্ন। 

মাহমুদুল হকের সাহিত্য নিসন্দেহে স্থান নিয়েছে চিরায়ত সাহিত্যের সারিতে। 

তার উপন্যাস জীবন আমার বোন শুধু সময়ের চিত্র নয়, ইতিহাসকে গল্পের মধ্যে দিয়ে আনা নয় সেখানে রয়ে গেছে আরো অনেক কিছু। 

তরুণ প্রজম্মের পাঠকের কাজে তাই তুলে দেয়া হলো মাহমুদুল হকের এই অনবদ্য উপন্যাস জীবন আমার বোন। আর আগের প্রজম্ম নিশ্চয়ই নতুন করে আরেকবার গ্রহন করুক এক অমৃত সাহিত্য। – সম্পাদক

মাহমুদুল হক

এইসব ভূত যেন কখনো আমার কাঁধে ভর না ক’রে, খোকা ভবিষ্যতের প্লীস্থ গাড়তে থাকে মনে মনে; ভিতরে যে ভুড়ভূড়ে পাঁক আর গরল জমে আছে খোকার ইচ্ছে নয় তা ঘাঁটাঘাঁটি করার। মিস্ট্রেস রাখলে কেমন হয়। জাঁ পল সাত্র আর সাইমন দ্য ব্যভেয়ার আমাদের আদর্শ হওয়া উচিত। কিন্তু ফরাসী মেজাজ তো আর আমানি খেয়ে খেত চ’ষে আর পাট জাগ দিয়ে ধার পাওয়া সম্ভব নয়, আমরা সবাই এক একটা ভোঁদড়, ভুষিমাল, একুশে ফেব্রুয়ারি ভেঙে খাচ্ছি এখনো; গোটা দেশ কলের লাঙ্গল দিয়ে চ’ষে বেড়ালেও একজন বিদগ্ধ মানুষ খুঁজে বের করা যাবে না, হুব্বা, গেঁড়ে, সবক’টা দিকপালই এক একটা আনকুথ, এক একটা গাঁইগুঁই, গুফি!
দ্য এসিয়েৎ এর বৈদগ্ধ চাই, চোখ চাই এর্নস্ট্র-এর। ফাঁক পেলেই ঝি চাকরানীকে পটাপাট বিয়ে ক’রে ফেলা মেজাজ আমাদের। বড় বড় ‘পাট্টিতে’ সুটবুটওলারা ট্যারা চোখে ঘ্যাঁসঘ্যাঁস ক’রে পাছা চুলকায় আর শব্দ ক’রে ঢেকুর তোলে এখনো। নাজ সিনেমায় খেলে যাওয়া রঙীন মলাটের বই কিনে বাঁশের বক কক্সবাজারি ঝিনুক শামুক আর প্লাসটিকের খেলনার সঙ্গে সাজিয়ে রাখে ড্রইংরুমে ঘটা ক’রে। গোটা দেশের মানুষজনই এক একটা ভুষিমাল, যে যার লাইনে দাঁড়িয়ে ঘাড়ের পাউডার মুছছে আর পিচ পিচ ক’রে পানের পিক ফেলছে, গুফি! গুফি!
মুরাদ তার মুখের দিকে তাকিয়ে ব’সে আছে নীরবে। ভালো লাগে না খোকার। তার চোখ একটা পলকা প্রজাপতির মতো এখানে-ওখানে উড়ে বেড়ায়, গাছে গাছে, পাতায় পাতায়, স্বপ্নের গর্ভকেশরে:
সবকিছুই একটা স্বপ্ন। স্বপ্নের ভিতরে আমরা জন্মাই, স্বপ্নের ভিতরে আমরা চিৎকার ক’রে উঠি, ঝনঝন ভেঙে যায় সব কাচ, তির তির ক’রে কেঁপে ওঠে দুধের সর, কৌমার্যের পাতলা পর্দা। স্বপ্নের ভিতরে আমরা স্তন্যপান করি, স্বপ্নের ভিতরে আমরা শিল কুড়াই, স্বপ্নের ভিতরে আমরা বকুল ফুলের মালা গাঁথি, স্বপ্নের ভিতরে অঞ্জু পুকুরে প’ড়ে যায়, স্বপ্নের ভিতরে মঞ্জু তাকে ধরতে যায়, স্বপ্নের ভিতরে নীলাভাবী কাচের চুড়ির শোকেস হ’য়ে যায়, স্বপ্নের ভিতরে রাজীব ভাই বৈদুর্য-বিদূম হাতড়ায়, স্বপ্নের ভিতরে ফিয়াট ঝড় হ’য়ে ওড়ে, স্বপ্নের ভিতরে বেলী রাউস ছিঁড়ে ফ্যালে, স্বপ্নের ভিতরে লিপস্টিক জড় হয়, স্বপ্নের ভিতরে লুলু চৌধুরী কান ধ’রে টানে, স্বপ্নের ভিতরে মোদিল্লিয়ানী রঙ জুড়ে দেয়, স্বপ্নের ভিতরে অর্ধেন্দু মুখ পুড়িয়ে ফেলে, স্বপ্নের ভিতরে মতিযুর শালিক হ’য়ে যায়, স্বপ্নের ভিতরে প্রীতি বিষ গলায় ঢালে, স্বপ্নের ভিতর হাইপোস্টাইল হল ভেঙে পড়ে, স্বপ্নের ভিতর পার্থেনন গমগম ক’রে বাজে, স্বপ্নের ভিতরে পাপ পুণ্য হ’য়ে যায়, স্বপ্নের ভিতরে আত্তিলা ঘোড়া ছুটিয়ে চলে, স্বপ্নের ভিতরে অন্ধকার হড়াম ক’রে ওঠে, স্বপ্নের ভিতরে দেখতে দেখতে আমরা আরেক স্বপ্ন হ’য়ে যাই।
এইসব মনে হয় খোকার।
কাচের একটি বিশাল স্বচ্ছ গোলাকার চিমনির ভিতর মাছির মতো বারবার পিনপিন ক’রে ঘুরতে থাকে এইসব স্বপ্ন।
খুব কাছে, লেকের কোল ঘেঁসে কয়েকটি সাদা রাজহাঁস; খোকার মনে হয় স্বপ্ন। কালো বরফ, নীল চাঁদ, সবুজ সূর্য, রক্তবৃষ্টি, মাংসবৃষ্টি-
এক একটি রাজহাঁস। স্তন, শিল, পুকুর, কাচের শোকেস, বিম, ছেঁড়া ব্লাউস, লিপস্টিক, বিষ, শালিক, হাইপোস্টাইল হল, সবকিছু রাজহাঁসের একটি পালক।
খোকা এমনভাবে আচ্ছন্ন হ’য়ে পড়ে যাতে একটি সিগ্রেটের পুরোটাই আঙুলের ফাঁকে নিঃশব্দে পুড়ে যায়।

 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024