শ্রী নিখিলনাথ রায়
মুতাক্ষরীনকার প্রকারান্তরে এই ঘটনাটিকে ঈশ্বরকৃত বলিয়া, হোসেন, কুলী খাঁর মহত্ব ও সিরাজের নিষ্ঠুরতা প্রতিপাদনের প্রয়াস পাইয়াছেন। এরূপ ঘটনার ভিত্তি জনপ্রবাদ ব্যতীত আর কিছুই নহে। বাস্তবিক এরূপ ঘটনা ঘটিবার যদি সম্ভাবনাও থাকে, এরূপ স্থলে তাহা যে ঘটিতে পারে, ইহা কদাচ বিশ্বাস করিতে পারা যায় না। যে ব্যক্তি স্বীয় প্রভুপত্নীর ধর্মনাশ সাধন করিয়া, একটি সংসারকে ঘোরতর পাপপঙ্কে নিমগ্ন করিয়াছিল, ভগবানের অপক্ষপাত বিচারে সে যদি সাধুপ্রকৃতি বলিয়া পরিগণিত হয়, আর যে স্বীয় জননীর ধর্মধ্বংসকারীর হত্যার আদেশ প্রদান করিয়াছিল, সে যদি শয়তানতুল্য বলিয়া বিবেচিত • হইয়া উঠে, তাহা হইলে, ন্যায় ধৰ্ম্ম ভগবানের রাজ্যে আছে বলিয়া কে বিশ্বাস করিতে পারে? ভগবানের এরূপ বিসদৃশ নীতি যাঁহাদের ইচ্ছা হয়, অনুমোদন করিতে পারেন, আমরা কিন্তু, যতদিন পর্যন্ত ন্যায়, ধৰ্ম্ম ও পবিত্রতা জগতে বিমান থাকিবে, ততদিন তাহা কদাচ অনুমোদন করিতে পারিব না।
যাহা হউক সিরাজের ছিন্নভিন্ন দেহ হস্তিপৃষ্ঠে মুর্শিদাবাদের প্রতি রাজপথে ভ্রমণ করাইয়া, অবশেষে তাঁহার মাতার বাসভবনের দ্বারে আনীত হয়। অন্তঃপুরমধ্যে আবদ্ধ থাকায়, সিরাজের মাতা এই মহাবিপ্লবের কিছুই অবগত ছিলেন না। তিনি চারিদিকে গোলযোগ শুনিয়া, কারণানু- ‘ সন্ধানে সমস্তই জানিতে পারিলেন। তখন তিনি আত্মবিস্মৃত হইয়া অবগুণ্ঠন উন্মোচনপূর্ব্বক দ্রুতপদে রাজপথে উপস্থিত হইলেন।
যাঁহার ভাগ্যে, সকল সময় সূর্য্যের আলোক দেখা ঘটিয়া উঠিত না, পুত্রের তাদৃশ শোচনীয় পরিণামশ্রবণে, তিনি আজ রাজপথে উপস্থিত! অনন্তর তিনি হস্তিপৃষ্ঠ হইতে তনয়ের মৃতদেহ নামাইয়া, পুনঃ পুনঃ চুম্বনপূর্ব্বক, তাহা বক্ষঃস্থলে ধারণপূর্ব্বক ছিন্নমূলা ব্রততীর ন্যায় ভূতলে পতিত হইলেন এবং অনবরত নিম্ন বক্ষে ও মুখে করাঘাত করিতে লাগিলেন। এই বৃক্ষে নগরবাসী সকলের হৃদয় বিগলিত ও অশ্রুধারায় প্লাবিত হইল।
নবাব আলিবর্দীর কন্যা ও সিরাজ-জননীর রাজপথে এইরূপ শোচনীয় আস্থা দেখিয়া খাদেম হোসেন খাঁ নামক জনৈক সম্ভ্রান্ত মুসলমান অনুচরসহ তথায় উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে ও অন্যান্য স্ত্রীলোক- দিগকে বলপূর্ব্বক অন্তঃপুরমধ্যে লইয়া যান। অনন্তর সিরাজের মৃতদেহ নদীর পরপারে খোশবাগে প্রেরিত ও আলিবর্দীর পার্শ্বে সমাহিত করা ‘হইল। সিরাজের শোচনীয় পরিণাম মনে করিতে গেলে, বাস্তবিক হৃদয় কারুণ্যরসে আপ্লুত হইয়া পড়ে।
Leave a Reply