০৫:০৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫
সাভার–কেরানীগঞ্জসহ শিল্পাঞ্চলে সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে ভালুকায় সহিংস ঘটনার পর মহাসড়কে যান চলাচলে বিঘ্ন গাজীপুরে শীত বেড়ে যাওয়ায় অসহায়দের জন্য জরুরি সহায়তা কক্সবাজার–হাতিয়া সমুদ্রপথে ক্ষেপণাস্ত্র মহড়া, নৌ চলাচলে সতর্কতা ময়মনসিংহে তীব্র শীত ও কুয়াশায় জনজীবন বিপর্যস্ত গ্রাহক বৃদ্ধি কমায় বড় বাজেটের সিরিজ নিয়ে নতুন হিসাব কষছে স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলো শীত ও জলবায়ু চাপে শহরমুখী হচ্ছে বন্যপ্রাণী, বাড়ছে মানব-প্রাণী সংস্পর্শ চরম শীতে বিদ্যুৎ ব্যবস্থার ওপর চাপ বাড়ছে, বৈশ্বিক জ্বালানি অবকাঠামোর দুর্বলতা প্রকাশ সংযুক্ত আরব আমিরাত–পাকিস্তান সম্পর্ক নতুন উচ্চতায়, বাণিজ্য ও বিনিয়োগে জোর লাইফ এন্ডাওমেন্ট উদ্যোগে গুরুতর রোগীদের নতুন আশার আলো, একশ চল্লিশ রোগীর চিকিৎসায় টেকসই অর্থায়ন শুরু

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-৬)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:০৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • 86

জীবনকথা

কিন্তু অল্পদিনেই তিনি অন্যান্য দেশ-হিতকর কার্যে মনোনিবেশ করিলেন। স্কুল ছাড়িয়া তাঁহার যে মনোব্যথা হইয়াছিল তাহা তিনি অল্পদিনেই সামলাইয়া লইলেন। আমার পিতার শিক্ষকতার প্রথম জীবনে আমাদের সাংসারিক অবস্থা বিশেষ ভালো ছিল না। পৈতৃক কয়েক বিঘা মাত্র জমিজমা ছিল। তাহাই ভাগে চাষ করিয়া অর্ধেক ফসলে আমাদের আট-নয় মাসের খোরাক হইত। স্কুলের কাজ ছাড়া বিবাহ পড়াইয়া, মৃতের জানাজা দিয়া, মহাজনের খত ও নৌকার চালান লিখিয়া বাজানের আরও সামান্য সামান্য আয় হইত। আমাদের গ্রামে মুসলমানেরা কেহই টাকা কর্জ দিয়া সুদের ব্যবসা করিত না। তাঁতিপাড়ার কারিকরেরা যদিও মুসলমান, আমাদের পাড়ার লোকদের সঙ্গে তাহারা এক মালতে থাকিত না, অথবা আমরাই তাহাদিগকে আমাদের মালতে লইতাম না। তাহার কারণও ছিল। তাঁতিরা কেহ কেহ টাকা কর্জ দিয়া সুদ লইত। হিন্দুদের মতো তাহাদের মেয়েরা পানি আনিতে নদীতে যাইত। আমাদের পাড়ার মেয়েরা নদীতে যাইত না। পানির জন্য প্রায় বাড়িতেই পাতকুয়া থাকিত। ইহার ফলে এই হইয়াছিল, দেশে কলেরা মহামারি আসিলে প্রথমেই তাঁতিপাড়ায় আসিয়া আস্তানা গাড়িত। কারণ তাঁতিরা নদীর পানি খাইত। নদীর পানিই কলেরার সময় সবচাইতে মারাত্মক ছিল।

যদিও সুদে টাকা খাটানো আমাদের পাড়ায় নিষিদ্ধ ছিল, কিন্তু সুদে টাকা ধার করা বা সুদী মহাজনের খত লিখিয়া দেওয়া কোনো অপরাধের মধ্যে গণ্য ছিল না। প্রত্যেকখানা খত লিখিয়া বাজান চারি আনা করিয়া পাইতেন। মহাজনের নৌকা লইয়া যাহারা বিদেশে বা অন্য গ্রামে ব্যবসা করিতে যাইত, মহাজন তাহাদিগকে কিছু টাকা ব্যবসার জন্য ধার দিত। ব্যবসায়ে লাভ হইলে তাহার এক অংশ নৌকার জন্য এবং এক অংশ অগ্রিম টাকার জন্য মহাজন পাইত। নৌকার বেপারী ও ভাগীরা সকলে মিলিয়া মহাজনের নিকট একটি চুক্তিপত্র লিখিয়া দিত। ইহাকে চালান বলে। এই চালান লিখিয়া দিয়াও বাজান আট আনা করিয়া পাইতেন।

বহুকাল হইতে আমাদের বংশের একজন না একজন দুই তিন গ্রামের মোল্লাকির ভার পাইতেন। আমার পিতার চাচা জহিরউদ্দীন মোল্লা আমাদের গ্রামের মোল্লা ছিলেন। কি কারণে তিনি দেশ ছাড়িয়া মালদা চলিয়া যাওয়ায় গ্রামের মোল্লাকির ভার আমার পিতার উপর পড়ে। এই উপলক্ষে পীর বাদশা মিয়ার দাদা দুদুমিয়া বাজানকে একটি সনদ দিয়াছিলেন। গ্রাম্য চাষিদের বিবাহ পড়াইয়া বাজান এক টাকা হইতে তিন টাকা পর্যন্ত পাইতেন। মৃতের জানাজা পড়াইয়াও তিনি মাঝে মাঝে কাঁসার থালাখানা বা ঘটিটি বাটিটি পাইতেন। এখনও আমাদের গ্রামের বাড়িতে সেইসব খালি বাসনের দু’একটি নিদর্শন আছে।

এর পরে আমার পিতার আর্থিক অবস্থা যখন আরও খারাপ হইয়া পড়ে তখন আমাদেরই মোল্লাবংশের বচন মোল্লা নামক এক ব্যক্তি বাজানের প্রতিদ্বন্দ্বী হইয়া পড়েন। একটি উপলক্ষে গ্রামের অধিকাংশ লোক বচন মোল্লাকে মোল্লা বলিয়া মানিয়া লইল। বাজানের পক্ষে মাত্র দুইচার ঘর লোক রহিল। ইহার পরে আমাদের সাংসারিক অবস্থা যখন ভালো হইল বাজান নিজেই ডাকিয়া সমস্ত মোল্লাকির ভার বচন মোল্লাকে ছাড়িয়া দিলেন। গ্রাম্য বিচার-আচারে বাজান মাতবরের পদবি পাইলেন।

আগেকার দিনে গ্রামদেশে পাকা মুসলমান খুব কমই দেখা যাইত। লক্ষ্মীপূজা, হাওই সিন্নি ও গাস্বীর উৎসবে সমস্ত গ্রাম মাতিয়া উঠিত। হাওয়া বিবির সম্মানে হাওয়া সিন্নি হইত। খুব সম্ভব লক্ষ্মী পূর্ণিমার পরের পূর্ণিমায় হাওয়া সিন্নির উৎসব হইত। একটি চিত্রিত হাঁড়ির মধ্য খইমুড়ির মোয়া, লাড্ডু, বাতাসা প্রভৃতি ভরিয়া শূন্যে ঝুলাইয়া রাখা হইত। সামনে থাকিত দু’চারখানা পাকা কলার কাঁদি। আমার পূর্বপুরুষেরা এইসব উৎসবে কোরানশরিফ পড়িয়া আসিতেন। তাঁহারা বলিতেন লোকে তো এসব উৎসব করিবেই। আমরা ইহার মধ্যে কোরানশরিফ পড়িয়া কিছুটা মুসলমানিত্ব বজায় রাখি।

 

(চলবে)…..

 

জনপ্রিয় সংবাদ

সাভার–কেরানীগঞ্জসহ শিল্পাঞ্চলে সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-৬)

১১:০০:০৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪

জীবনকথা

কিন্তু অল্পদিনেই তিনি অন্যান্য দেশ-হিতকর কার্যে মনোনিবেশ করিলেন। স্কুল ছাড়িয়া তাঁহার যে মনোব্যথা হইয়াছিল তাহা তিনি অল্পদিনেই সামলাইয়া লইলেন। আমার পিতার শিক্ষকতার প্রথম জীবনে আমাদের সাংসারিক অবস্থা বিশেষ ভালো ছিল না। পৈতৃক কয়েক বিঘা মাত্র জমিজমা ছিল। তাহাই ভাগে চাষ করিয়া অর্ধেক ফসলে আমাদের আট-নয় মাসের খোরাক হইত। স্কুলের কাজ ছাড়া বিবাহ পড়াইয়া, মৃতের জানাজা দিয়া, মহাজনের খত ও নৌকার চালান লিখিয়া বাজানের আরও সামান্য সামান্য আয় হইত। আমাদের গ্রামে মুসলমানেরা কেহই টাকা কর্জ দিয়া সুদের ব্যবসা করিত না। তাঁতিপাড়ার কারিকরেরা যদিও মুসলমান, আমাদের পাড়ার লোকদের সঙ্গে তাহারা এক মালতে থাকিত না, অথবা আমরাই তাহাদিগকে আমাদের মালতে লইতাম না। তাহার কারণও ছিল। তাঁতিরা কেহ কেহ টাকা কর্জ দিয়া সুদ লইত। হিন্দুদের মতো তাহাদের মেয়েরা পানি আনিতে নদীতে যাইত। আমাদের পাড়ার মেয়েরা নদীতে যাইত না। পানির জন্য প্রায় বাড়িতেই পাতকুয়া থাকিত। ইহার ফলে এই হইয়াছিল, দেশে কলেরা মহামারি আসিলে প্রথমেই তাঁতিপাড়ায় আসিয়া আস্তানা গাড়িত। কারণ তাঁতিরা নদীর পানি খাইত। নদীর পানিই কলেরার সময় সবচাইতে মারাত্মক ছিল।

যদিও সুদে টাকা খাটানো আমাদের পাড়ায় নিষিদ্ধ ছিল, কিন্তু সুদে টাকা ধার করা বা সুদী মহাজনের খত লিখিয়া দেওয়া কোনো অপরাধের মধ্যে গণ্য ছিল না। প্রত্যেকখানা খত লিখিয়া বাজান চারি আনা করিয়া পাইতেন। মহাজনের নৌকা লইয়া যাহারা বিদেশে বা অন্য গ্রামে ব্যবসা করিতে যাইত, মহাজন তাহাদিগকে কিছু টাকা ব্যবসার জন্য ধার দিত। ব্যবসায়ে লাভ হইলে তাহার এক অংশ নৌকার জন্য এবং এক অংশ অগ্রিম টাকার জন্য মহাজন পাইত। নৌকার বেপারী ও ভাগীরা সকলে মিলিয়া মহাজনের নিকট একটি চুক্তিপত্র লিখিয়া দিত। ইহাকে চালান বলে। এই চালান লিখিয়া দিয়াও বাজান আট আনা করিয়া পাইতেন।

বহুকাল হইতে আমাদের বংশের একজন না একজন দুই তিন গ্রামের মোল্লাকির ভার পাইতেন। আমার পিতার চাচা জহিরউদ্দীন মোল্লা আমাদের গ্রামের মোল্লা ছিলেন। কি কারণে তিনি দেশ ছাড়িয়া মালদা চলিয়া যাওয়ায় গ্রামের মোল্লাকির ভার আমার পিতার উপর পড়ে। এই উপলক্ষে পীর বাদশা মিয়ার দাদা দুদুমিয়া বাজানকে একটি সনদ দিয়াছিলেন। গ্রাম্য চাষিদের বিবাহ পড়াইয়া বাজান এক টাকা হইতে তিন টাকা পর্যন্ত পাইতেন। মৃতের জানাজা পড়াইয়াও তিনি মাঝে মাঝে কাঁসার থালাখানা বা ঘটিটি বাটিটি পাইতেন। এখনও আমাদের গ্রামের বাড়িতে সেইসব খালি বাসনের দু’একটি নিদর্শন আছে।

এর পরে আমার পিতার আর্থিক অবস্থা যখন আরও খারাপ হইয়া পড়ে তখন আমাদেরই মোল্লাবংশের বচন মোল্লা নামক এক ব্যক্তি বাজানের প্রতিদ্বন্দ্বী হইয়া পড়েন। একটি উপলক্ষে গ্রামের অধিকাংশ লোক বচন মোল্লাকে মোল্লা বলিয়া মানিয়া লইল। বাজানের পক্ষে মাত্র দুইচার ঘর লোক রহিল। ইহার পরে আমাদের সাংসারিক অবস্থা যখন ভালো হইল বাজান নিজেই ডাকিয়া সমস্ত মোল্লাকির ভার বচন মোল্লাকে ছাড়িয়া দিলেন। গ্রাম্য বিচার-আচারে বাজান মাতবরের পদবি পাইলেন।

আগেকার দিনে গ্রামদেশে পাকা মুসলমান খুব কমই দেখা যাইত। লক্ষ্মীপূজা, হাওই সিন্নি ও গাস্বীর উৎসবে সমস্ত গ্রাম মাতিয়া উঠিত। হাওয়া বিবির সম্মানে হাওয়া সিন্নি হইত। খুব সম্ভব লক্ষ্মী পূর্ণিমার পরের পূর্ণিমায় হাওয়া সিন্নির উৎসব হইত। একটি চিত্রিত হাঁড়ির মধ্য খইমুড়ির মোয়া, লাড্ডু, বাতাসা প্রভৃতি ভরিয়া শূন্যে ঝুলাইয়া রাখা হইত। সামনে থাকিত দু’চারখানা পাকা কলার কাঁদি। আমার পূর্বপুরুষেরা এইসব উৎসবে কোরানশরিফ পড়িয়া আসিতেন। তাঁহারা বলিতেন লোকে তো এসব উৎসব করিবেই। আমরা ইহার মধ্যে কোরানশরিফ পড়িয়া কিছুটা মুসলমানিত্ব বজায় রাখি।

 

(চলবে)…..