০১:৩৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৬)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:২৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • 20

জীবনকথা

সেখানে যাইয়া গোসা করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিতাম। বাজান আসিয়া অনেক সাধ্যসাধনা করিয়া আমাকে ফিরাইয়া লইয়া যাইতেন। আজকাল আগেকার মতো সেই মিলাদ আর নাই। মৌলবি সাহেবরা মিলাদের মাহফেলে বক্তৃতা করেন। এই বক্তৃতায় কার কতটুকু উপকার হয় জানি না, কিন্তু মনসুর মৌলবি সাহেব মিলাদ পড়িতে কোরান কেতাব ঘাঁটিয়া অনেক সুন্দর সুন্দর কাহিনী বলিতেন। লাইলি মজনুর কেচ্ছা, ইউছুফ জোলেখার কেচ্ছা, মহরমের কেচ্ছা, ইসমাইলের কোরবানির কেচ্ছা, প্রভৃতি কত কাহিনীই না তিনি বলিতেন। খাওয়াদাওয়ার পরে তিনি মিলাদ আরম্ভ করিতেন। এই মিলাদের সময় কাহিনী বলিতে মাঝে মাঝে তিনি সুর করিয়া দরুদশরিফ পড়িতেন। শ্রোতারাও তার সঙ্গে যোগ দিত।

কাহিনীর করুণ স্থানে আসিয়া তাঁহার সুন্দর মুখখানা অশ্রুসিক্ত হইয়া উঠিত। শ্রোতারাও সেইসঙ্গে কাঁদিয়া আকুল হইত। কোনো কোনো সময় মিলাদ শেষ হইতে রাত্র ভোর হইয়া যাইত। শ্রোতারা গৃহে ফিরিয়া যাইতে সেই কাহিনীর আদর্শবাদ তাহারা মনে আঁকিয়া লইয়া যাইত। তাহাদের নিত্যনৈমিত্তিক কাজে আত্মীয় পরিজনের প্রতি ব্যবহারে এই আদর্শবাদ অনেকখানি প্রভাব বিস্তার করিত। মনসুর মৌলবি সাহেবের পরে গৈজদ্দীন মুন্সী সাহেব আমাদের গ্রামে আসিয়া মিলাদ পড়িতেন। তিনিও মিলাদের মাহফেলে সুন্দর সুন্দর কাহিনী বলিতেন। গ্রামের অশিক্ষিত চাষীরা অতি উৎসাহের সঙ্গে তাঁহার মিলাদ পড়া শুনিত। আগেকার দিনে মৌলবি হইতে হইলে অনেক পড়াশুনার প্রয়োজন ছিল না।

কোরানশরিফের দু’চারটি সুরা সুর করিয়া পড়িয়া গোলেস্তা বুস্তা অথবা অন্যান্য গ্রন্থ হইতে যিনি সুন্দর সুন্দর গল্প বলিতে পারিতেন। তিনিই মৌলবি হইতেন। গল্প বলার ক্ষমতা খোদাদত্ত, ইহা কেহ ইচ্ছা করিয়া আয়ত্ত করিতে পারে না। তাই আগেকার মৌলবিরা মিলাদ পড়ার ক্ষমতা লইয়াই জন্মগ্রহণ করিতেন। এখনকার মৌলবিরা কোরান কেতাব পড়িয়া বক্তৃতা করেন। তাই প্রথা হিসাবে মিলাদের প্রচলন এখন যদিও আছে, আগেকার মতো মিলাদের মাহফিলে শ্রোতাদের তেমন আগ্রহ দেখা যায় না। আমার প্রথম জীবনে এই মৌলবি সাহেবের যে প্রভাব পড়িয়াছিল, তাহার জন্য আজও আমি আর দশজনের মতো আমাদের আলেমসমাজকে সমালোচকের দৃষ্টিতে দেখিতে পারি না। পূর্বকালে এঁরা আমাদের সমাজে যে আদর্শবাদের বীজ রোপণ করিয়া গিয়াছেন তাহা স্মরণ করিয়া কৃতজ্ঞতায় আমার অন্তর ভরিয়া উঠে।

কিন্তু তাই বলিয়া আধুনিক কোনো ভণ্ড মৌলানাকে আমি সমর্থন করি না। কাজী নজরুলের সঙ্গে আমার নিবিড় সম্পর্ক ছিল। আমার ‘মুন্সী সাহেব’ কবিতাটি যখন সওগাতে ছাপা হয়, তিনি ঠাট্টা করিয়া বলিয়াছিলেন, “দেখ গিয়া, তোমার কবিতাটি কাঠমোল্লারা মসজিদের দেয়ালে দেয়ালে লটকাইয়া রাখিয়াছে।” এই উপহাসে আমি এতটুকুও লজ্জিত হই নাই। নজরুলের সঙ্গে আমার সাহিত্যিক আত্মীয়তা থাকিলেও আমরা দুইজনে দুই জগতের লোক। নজরুল ছিলেন বিদ্রোহী-ভাঙার প্রতীক। তিনি বলিতেন, “আমি আগে ভাঙিয়া যাইব। তারপর সেখানে নব-নবীনেরা আসিয়া নতুন সৃষ্টির উল্লাসে মাতিবে।” আমি বলিতাম, “আমাদের যা আছে তারই উপর নতুন সৃষ্টি করিতে হইবে। পুরাতনের ভিতরে যা কিছু মণিমাণিক্য আছে তাহা ঘষিয়া-মাজিয়া লোকচক্ষুর গোচর করিতে হইবে।” যাক সে কথা।

মনসুর মৌলবি সাহেব বিবাহ করিয়াছিলেন আমাদের গ্রাম হইতে যোলো-সতেরো মাইল দূরে চরভদ্রাসন গ্রামে। আমার পিতা মাঝে মাঝে সেই গ্রামে বেড়াইতে যাইতেন। শুনিয়াছি, আমার পিতার মতো একজন শিক্ষিত লোককে দেখিবার জন্য সেখানে গ্রাম-গ্রামান্তর হইতে বহুলোক আসিয়া জড় হইত। আর এ-বাড়ি ও-বাড়ি দাওয়াতের তো অন্তই ছিল না। প্রত্যেক বারই অন্তত শতলোক তাঁহার সঙ্গে আহারে নিমন্ত্রিত হইত। এই গ্রামের লোকেরাও ফরিদপুরের মামলা মকর্দমা করিতে আমাদের বাড়ি আসিয়া অতিথি হইতেন।

 

(চলবে)……..
জনপ্রিয় সংবাদ

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৬)

১১:০০:২৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

জীবনকথা

সেখানে যাইয়া গোসা করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিতাম। বাজান আসিয়া অনেক সাধ্যসাধনা করিয়া আমাকে ফিরাইয়া লইয়া যাইতেন। আজকাল আগেকার মতো সেই মিলাদ আর নাই। মৌলবি সাহেবরা মিলাদের মাহফেলে বক্তৃতা করেন। এই বক্তৃতায় কার কতটুকু উপকার হয় জানি না, কিন্তু মনসুর মৌলবি সাহেব মিলাদ পড়িতে কোরান কেতাব ঘাঁটিয়া অনেক সুন্দর সুন্দর কাহিনী বলিতেন। লাইলি মজনুর কেচ্ছা, ইউছুফ জোলেখার কেচ্ছা, মহরমের কেচ্ছা, ইসমাইলের কোরবানির কেচ্ছা, প্রভৃতি কত কাহিনীই না তিনি বলিতেন। খাওয়াদাওয়ার পরে তিনি মিলাদ আরম্ভ করিতেন। এই মিলাদের সময় কাহিনী বলিতে মাঝে মাঝে তিনি সুর করিয়া দরুদশরিফ পড়িতেন। শ্রোতারাও তার সঙ্গে যোগ দিত।

কাহিনীর করুণ স্থানে আসিয়া তাঁহার সুন্দর মুখখানা অশ্রুসিক্ত হইয়া উঠিত। শ্রোতারাও সেইসঙ্গে কাঁদিয়া আকুল হইত। কোনো কোনো সময় মিলাদ শেষ হইতে রাত্র ভোর হইয়া যাইত। শ্রোতারা গৃহে ফিরিয়া যাইতে সেই কাহিনীর আদর্শবাদ তাহারা মনে আঁকিয়া লইয়া যাইত। তাহাদের নিত্যনৈমিত্তিক কাজে আত্মীয় পরিজনের প্রতি ব্যবহারে এই আদর্শবাদ অনেকখানি প্রভাব বিস্তার করিত। মনসুর মৌলবি সাহেবের পরে গৈজদ্দীন মুন্সী সাহেব আমাদের গ্রামে আসিয়া মিলাদ পড়িতেন। তিনিও মিলাদের মাহফেলে সুন্দর সুন্দর কাহিনী বলিতেন। গ্রামের অশিক্ষিত চাষীরা অতি উৎসাহের সঙ্গে তাঁহার মিলাদ পড়া শুনিত। আগেকার দিনে মৌলবি হইতে হইলে অনেক পড়াশুনার প্রয়োজন ছিল না।

কোরানশরিফের দু’চারটি সুরা সুর করিয়া পড়িয়া গোলেস্তা বুস্তা অথবা অন্যান্য গ্রন্থ হইতে যিনি সুন্দর সুন্দর গল্প বলিতে পারিতেন। তিনিই মৌলবি হইতেন। গল্প বলার ক্ষমতা খোদাদত্ত, ইহা কেহ ইচ্ছা করিয়া আয়ত্ত করিতে পারে না। তাই আগেকার মৌলবিরা মিলাদ পড়ার ক্ষমতা লইয়াই জন্মগ্রহণ করিতেন। এখনকার মৌলবিরা কোরান কেতাব পড়িয়া বক্তৃতা করেন। তাই প্রথা হিসাবে মিলাদের প্রচলন এখন যদিও আছে, আগেকার মতো মিলাদের মাহফিলে শ্রোতাদের তেমন আগ্রহ দেখা যায় না। আমার প্রথম জীবনে এই মৌলবি সাহেবের যে প্রভাব পড়িয়াছিল, তাহার জন্য আজও আমি আর দশজনের মতো আমাদের আলেমসমাজকে সমালোচকের দৃষ্টিতে দেখিতে পারি না। পূর্বকালে এঁরা আমাদের সমাজে যে আদর্শবাদের বীজ রোপণ করিয়া গিয়াছেন তাহা স্মরণ করিয়া কৃতজ্ঞতায় আমার অন্তর ভরিয়া উঠে।

কিন্তু তাই বলিয়া আধুনিক কোনো ভণ্ড মৌলানাকে আমি সমর্থন করি না। কাজী নজরুলের সঙ্গে আমার নিবিড় সম্পর্ক ছিল। আমার ‘মুন্সী সাহেব’ কবিতাটি যখন সওগাতে ছাপা হয়, তিনি ঠাট্টা করিয়া বলিয়াছিলেন, “দেখ গিয়া, তোমার কবিতাটি কাঠমোল্লারা মসজিদের দেয়ালে দেয়ালে লটকাইয়া রাখিয়াছে।” এই উপহাসে আমি এতটুকুও লজ্জিত হই নাই। নজরুলের সঙ্গে আমার সাহিত্যিক আত্মীয়তা থাকিলেও আমরা দুইজনে দুই জগতের লোক। নজরুল ছিলেন বিদ্রোহী-ভাঙার প্রতীক। তিনি বলিতেন, “আমি আগে ভাঙিয়া যাইব। তারপর সেখানে নব-নবীনেরা আসিয়া নতুন সৃষ্টির উল্লাসে মাতিবে।” আমি বলিতাম, “আমাদের যা আছে তারই উপর নতুন সৃষ্টি করিতে হইবে। পুরাতনের ভিতরে যা কিছু মণিমাণিক্য আছে তাহা ঘষিয়া-মাজিয়া লোকচক্ষুর গোচর করিতে হইবে।” যাক সে কথা।

মনসুর মৌলবি সাহেব বিবাহ করিয়াছিলেন আমাদের গ্রাম হইতে যোলো-সতেরো মাইল দূরে চরভদ্রাসন গ্রামে। আমার পিতা মাঝে মাঝে সেই গ্রামে বেড়াইতে যাইতেন। শুনিয়াছি, আমার পিতার মতো একজন শিক্ষিত লোককে দেখিবার জন্য সেখানে গ্রাম-গ্রামান্তর হইতে বহুলোক আসিয়া জড় হইত। আর এ-বাড়ি ও-বাড়ি দাওয়াতের তো অন্তই ছিল না। প্রত্যেক বারই অন্তত শতলোক তাঁহার সঙ্গে আহারে নিমন্ত্রিত হইত। এই গ্রামের লোকেরাও ফরিদপুরের মামলা মকর্দমা করিতে আমাদের বাড়ি আসিয়া অতিথি হইতেন।

 

(চলবে)……..