স্বদেশ রায়
বড় জ্যাঠামহাশয় এই বৈশাখে নিরানব্বই পূর্ণ করিয়া শতবর্ষে পা রাখিবেন। তাই এবারের ফাল্গুনের বাসন্তী পূঁজার অনান্য বারের থেকে সামান্য হইলেও একটু বাড়তি বিশেষত্ব আছে।
অনির্বানের ছোট বেলায় দেখা সেই মন্ডপ ঘরটি এখন এ বাড়িতে একটি অতীতের স্মৃতি মাত্র। এমনকি ১৯৭১’র পরে যাহাদের জম্ম তাহারা ভাবিতেও পারে না এ বাড়িতে অত বড় এবং অমনি কারুকার্যময় একটি মন্ডপ ঘর বংশানুক্রমে বহিয়া চলিয়াছিলো। তাহারও একটি জম্মসাল ঠিকুজিতে লেখা ছিলো। সে হিসাব করিলে তরুণ অনির্বানের কাছে এই মন্ডপ ঘরটিকে নিতান্ত একটি অস্থায়ী কিছু মনে হয়।
অবশ্য তাহাতে এ বাড়ির কাহারে চোখে মুখে এখন আর কোন দুঃখ বেদনা ফুটিয়া ওঠে না। ফুটিয়া উঠিবে কেমন করিয়া যাহাদের নিজেদের থাকিবার সেই কোঠাবাড়িতে এখন আর শুইয়া কোন পুরানো কড়ি বরগা দেখা যায় না, বরং তাহার বদলে নিতান্ত টিনের চালার ঘর- সেখানে তাহারা দেবতার জন্যে কীবা করিতে পারে! তবে তাহার পরেও এ বাড়িতে প্রতি দিনের সূর্যের সঙ্গে অসংখ্য ফুল ফোটে। পুরানো বড় পুকুর ঘাটটির ওপরের দুপাশের সিংহর মুর্তি দুইটি না থাকিলেও বেঞ্চ দুইটি এখনও পুরানো বট গাছের শেকড়ের মতো টিকিয়া আছে। অতীতের সেই ক্যালকাটা গ্রীলের মতো লোহার বেড়ার বদলে বাঁশের বেড়া আসিয়াছে, সেখানে আবার শিকড় থেকে জম্ম নেওয়া সাত রঙের জবা গাছগুলো অনেকটা বড় হইয়াছে। ‘৭১ সালে জবা গাছ গুলো কী দোষ করিয়াছিলো, যাহার জন্যে সেগুলো কাটিয়া ফেলিতে হইয়াছিলো- তাহা লইয়া অনির্বানের মনে কোনদিন কোন প্রশ্ন আসে নাই। এমনকি শ্বেতকরবী ও হলুদকরবী গাছ দুইটি কীভাবে বার্ধক্য লইয়া টিকিয়া আছে তাহাও তাহার মনে কোন প্রশ্ন তোলে না।
অবশ্য বাড়িটার সঙ্গে অনির্বানের যে খুব মেলামেশা আছে তাহা বলিবার সুযোগ কম। বরং অনির্বানকেও এ বাড়ির একজন আত্মীয় বলা যাইতে পারে। কারণ সেও পালা পার্বনে বাড়িতে আসে। বিশেষ করিয়া বাড়ির বার্ষিক কালী পূঁজায় ও বাসন্তী পূঁজায় তাহাকে বাড়ি আসিবার জন্যে লেখা হয়। সেই মিশনারী স্কুল বোর্ডিং থাকাকালীন হইতে এই রীতি চলিয়া আসিয়াছে।
হিন্দু বাড়ি হইলেও বাড়িটাতে একটা অদ্ভূত মিশেল ছোট বেলা হইতে অনির্বান বুঝিতে পারিতো। বিশেষ করিয়া তাহার প্রপিতামহ থেকে শুরু করে বাবা ও দুই জ্যাঠামহাশয় ইংরেজ আমলে কলিকাতায় পড়াশুনা ও কার্যক্রম থাকার কারণে এবং ব্রিটিশের সঙ্গে মেলামেশার ফলে তাহাদের ভেতর ব্রিটিশদের অনেক ভালো গুনের প্রতি শ্রদ্ধা যেমন জম্মিয়াছিলো- তেমনি তাহারা ব্রিটিশদের পোষাক আশাকে শুধু নয়,অনেক আচার আচরণে অভ্যস্ত ছিলো। আবার তাহার সঙ্গে সঙ্গে তাহার বাবা ও তাহার বাবার ইমিডিয়েট বড় ভাই দুই জনের ওপর ছিলো রামমোহনের গভীর প্রভাব। তাই ব্রিটিশ, ব্রাহ্ম ও হিন্দুত্ব সব মিলিয়া এ বাড়িতে একটি অদ্ভূত কম্বিনেশান অনির্বানের ছোট বেলায় শুধু নয় ‘৭১ অবধি টিকিয়া ছিলো। স্বাধীনতার ভিতর দিয়া আসা আর্থিক দুর্গতির মধ্যে দিয়া সব যেন কোথায় ভাসিয়া যাইতেছে তাহা অনির্বান বুঝিতে পারে।
তবে ছোট বেলা হইতে বাড়ি থেকে শিকড় উপড়াইয়া ফেলার কারণে হউক আর বাড়ির এই পরিবর্তনের কারণে হউক অনির্বান কেমন যেন বাড়ির সকলের সঙ্গে নিজেকে সহজ করিয়া লইতে পারে না। মা, বাবা, জ্যাঠাইমা ও জ্যাঠামহাশয়গন এমনি ছোট বেলায় যাহাদের সান্নিধ্য পাইয়াছিলো তাহাদের ছাড়া- বাদ বাকি সকলের সঙ্গে কেমন যেন আত্মীয়’র মতো তাহার নিজের একটা অলিখিত দুরত্ব আছে। তাই এ বাড়ির মানুষ হইলেও খুব যে নিঃসংকোচে সে বাড়ির পুকুরঘাট বা সমবয়সীদের অন্য কোন মজলিসে যাইতে পারে,তেমনটি নয়।
বাসন্তী পূঁজা উপলক্ষ্যে গত রাতে বাড়ি আসিয়া তাহার আজ সকালেও একই অবস্থা ঘটিলো। বাড়ির পূর্ব পাশে সব থেকে যে পুরানো পুকুরটি আছে সেখানে কম ভীড় ভাট্টা হইবে মনে করিয়া সে নীরবে বইচি,কামরাঙা ও করমচা গাছের পথ মাড়াইয়া পুকুরের পূর্ব উত্তর কোনের পাড়ে পা রাখিতেই দেখিতে পায় অনেক খানি ভেঙ্গে যাওয়া পুকুরের ঘাট অনেক অপিরিচিত আত্মীয়ারা দখল করিয়া আছে। তাই আর পুকুরের পশ্চিম পাশের এই ঘাটের দিকে পা না বাড়াইয়া ক্ষয়ে যাওয়া ওষুধি গাছের বাগানের উত্তর পাড়ের ভেতর দিয়া অনেকটা সাবধানে সে পুকুরের পূর্ব পাড়ে চলিয়া যায়।
অনির্বান যখন পুকুরের পূর্ব পাড়ে গিয়া পৌঁছায় তখন তাহার পেছন দিক হইতে সেদিনের নতুন সূর্যটি ওই দিন আবার একেবারেই নতুন করিয়া জম্ম লইয়া তাহার সোনা রঙ মেশানো রশ্মিগুলো ছড়াইয়া দিবার জন্য আনন্দিত হইয়াছে, আর তাহার সঙ্গে ফাল্গুনের নরম হাওয়া তাহা বহিয়া আনিবার দ্বায়িত্ব লইয়াছে।
ওই হাওয়া ও সূর্যের সোনালী আভা অর্নিবানের শরীরে পড়িতেই অনির্বান চমকিয়া ওঠে এবং তাহার দৃষ্টি ওই আলোর রশ্মির পথে পুকুরের পশ্চিম পাড়ের ভগ্মঘাটের দিকেই পড়ে। পুকুরের ভগ্নঘাটটির একপাশে লাল রক্তজবা ও অন্যপাশে হলুদ রাধাচূড়া ফুলের গাছ। সেদিন দুটো গাছেই বেশি ফুল ফুটিয়া ছিলো কিনা তাহা অনির্বান জানে না। তবে রক্তজবা নতুন সূর্যের আলোয় যেমন আরো বেশি লাল হইয়াছিলো তেমনি কাঁচা হলুদ রঙের রাধাচূড়া ফুলগুলোও আরো বেশি হলুদ হইয়া উঠিয়াছিলো। এই দুইকে ভেদ করিয়া অনির্বানের চোখ যেখানে আটকাইয়া যায় তাহা কোন ফুল নয় তবে ফুলের সকল সৌন্দর্য ঢাকিয়া দিয়া নিজেই সব দৃষ্টি কাড়িয়া লইতে সমর্থ এমনই একটি কিশোরী মুখ। রাধাচূড়া গাছটির পাশেই সে বসিয়া ছিলো। ওই নবীন সূর্যের আলো পড়া তাহার মুখের রঙ যে রাধাচূড়াকে ঢাকিয়া দিয়া সমস্ত পুকুরঘাটকে উজ্জল করিয়া তুলিতে শতভাগ সমর্থ হইয়াছিলো তাহার সত্যতা শুধু তরুণ অনির্বানের আনাড়ি চোখ নহে- যে কোন অভিজ্ঞ শিল্পীও স্বীকার করিবেন। অনির্বান শুধু তাহার মুখ দেখিলো না তাহার চোখেও তাহার চোখ পড়িলো। ইহাকে দৃষ্টি বিনিময় বলা যাইবে কিনা তাহা অবশ্য ক্ষনগণনার বিষয়। এমনকি কে আগে চোখ নামাইয়া লইলো তাহাও ক্ষণগননার খাতায় রহিয়া গেলো।
দৃষ্টি নামাইয়া অনির্বান আর বেশিক্ষণ সেখানে দাঁড়াইয়া থাকিতে পারিলো না। আবারও সে ওষুধি গাছের ফাঁকে ফাঁকে পা রাখিয়া বইচি ও করমচার তলা দিয়া নিজের ঘরে ফিরিয়া আসিলো। এবং পুঁজার বাড়িতেও জোর করিয়া পড়ার টেবিলে বসিবার চেষ্টা করিলো। পারিলো না। ব্রেকফাস্টেও কেমন যেন মনসংযোগ ঘটাইতে পারিলো না। সেখানেও নিজেকে আনমনা থেকে উদ্ধার করার কোন পথ পাইল না; বরং তাহা সংক্ষিপ্ত করিয়া ধীর পায়ে মন্ডপের দিকে আগাইয়া যায়। মন্ডপে তখন ঠাকুর গড়াইবার মূল কারিগর ও তাহার দুই বালক সহযোগীসহ কাজে মগ্ন। আর তাহাদের পেছনে উৎসুক চোখ লইয়া মন্ডপের ভেতর ও বাহিরের বারান্দা ভরিয়া যাহার বসিয়া আছে তাহাদেরকে বালক বালিকাই বলা যায়। অনির্বান মন্ডপের ভেতর ঢুকিতেই কারিগরের প্রয়োজন মেটানোর জন্যে বাড়ির যে লোকেরা কাজ করিতে ছিলো তাহাদের একজন তাহার জন্যে একটি বেতের চেয়ার আনিয়া দেয়। অনির্বান কোন বাক্য ব্যয় না করিয়া তাহাতে বসিয়া একাগ্র মনে প্রতিমা শিল্পির তুলির টানের দিকে তাহার চোখ নিবদ্ধ করে।
অনির্বানের এতক্ষণ পুঁজার দিনক্ষণ মনে ছিলো না তবে ভাস্করের তুলির টান দেখিয়া সে বুঝিতে পারিলো আগামী কালই পুঁজা শুরুর লগ্ন। ভাস্করের প্রতিটি তুলির টানে এখন প্রতিমা তাহার সম্মুখে জীবন্ত হইয়া উঠিতেছে। অনির্বান এই বাড়ির ওই কম্বিনেশানের শেষ ধারা কিনা তাহা সে জানে না। তাই এই প্রতিমার গায়ে ভাস্করের তুলির টানে বিবেকানন্দের মতে, মৃম্ময়ের মাঝে চিম্ময় প্রতিষ্ঠা হইতেছে কিনা তাহাও যেমন তাহার মনে আসিলো না তেমনি এক ব্রহ্মে বিশ্বাসী রামমোহন কেন কলিকাতায় এমনই হাজার হাজার পুঁজার ব্যবস্থা করিতেন তাহাও তাহার মনে আসিলো না। রবং তাহার চোখের সামনে ধীরে ধীরে ভাস্করের তুলির টানে প্রতিমার মুখটি যে আদল লইতে ছিলো তাহা সকালের যে মুখটি তাহার দৃষ্টিকে আনত করিয়া দিয়াছিলো সেই মুখটির আদল ও রঙ লইয়া জাগিয়া উঠিতে লাগিলো।
বাড়িতে শত শত আত্মীয় স্বজনের মধ্যে ওই মুখটি এখন কোথায় আছে তাহা অনির্বান জানে না। আবার তাহাকে খুঁজিতে যাইবার মতো বা তাহার নাম জানিবারও পথ খুঁজিতে সে মনের মধ্যে কোন সাহস বা তাড়না কোনটাই যে কেন বোধ করিলো না -তাহা সে নিজে কেন, কোন মনস্তাত্বিকও হয়তো বলিতে পারিতো না সে সময়ে। পৃথিবীর এই এক অদ্ভূত রহস্য, ভাষার এত বিস্তার ও গভীরতা ঘটিবার পরেও এখনও বহু কিছু রহিয়া গিয়াছে যাহা ভাষা দিয়া প্রকাশ করা যায় না। সন্ধ্যার অন্ধকারে বা উজ্জল সূর্যের আলোয় বলাকারা পাখা ঝাপটাইয়া উড়িয়া যায় -ওই বলাকার পাখার ধ্বনি কী আজো ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব হইয়াছে! যেখানে বলাকারা কত সহস্র বত্সর ধরিয়া উড়িতেছে তাহাদের পাখার ধ্বনি যখন ভাষায় রূপ পায়নি- সেখানে আজকের একটি দিনে, কোন এক অনির্বানের মনের মধ্য কী ঘটিয়াছে- তাহা যে ভাষায় রূপ দেওয়া যাইবে- এতটা সহজ কি পৃথিবীময় যাহা ঘটিতেছে প্রতি মুহূর্তে তাহার সকল কিছু! আর যাহার মনের মধ্যে ঘটিয়াছে সে যদি নিজেই তাহার ভাষা খুঁজিতে না চায় তাহা হইলে বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে অন্য কাহার কীবা ক্ষমতা থাকিতে পারে- তাহা খুঁজিবার বা প্রকাশ করিবার!
তবে মনের মধ্যে কোন কিছু না খুঁজিলেও প্রতিমার দিকে চোখ রাখিতে রাখিতে কেমন যেন অতি স্বাভাবিক সরল রেখায় অনির্বানের মনের মধ্যে স্থির হইয়া গেলো, সকালে যাহার মুখ দেখিয়া তাহার দৃষ্টি স্থির হইয়া- ধীরে ধীরে নত হইয়াছিলো তাহার নাম “প্রতিমা” । এই অধিকার অবশ্য শুধু অনির্বানের নয়, পৃথিবীর সকল মানুষের জম্মগত অধিকার। সে যে কোন কিছুরই, বিশেষ করিয়া ভালোলাগা, ভালোবাসার বা মুগ্ধ হইবার বিষয়কে- নিজের মতো করিয়া একটি নাম দিবার অধিকার রাখে।
প্রতিমা নামটি একটু সেকেলে হইয়া গেলো। যুগের সঙ্গে মিলিল না। কিন্তু অনর্বিানের এখানে নিজের কোন শক্তি রহিলো না- কারণ মন্ডপের প্রতিমার কারিগর নিজেই তুলির টানে টানে দুইটি মুখকে এক করিয়া সৃষ্টি করিতেছেন -সেখানে অনির্বানকে অসহায় বলা ছাড়া আর কিবা বলা যাইতে পারে।
বিকেলের দিকে বাড়িতে লোকজন আরো ভরিয়া ওঠে। শুধুমাত্র সামিয়ানা টাঙানো আসর গুলোতে নয়, অনেকগুলো ঘর হইতে গানের সুর ভাসিয়া আসিতেছিলো। সেখানে রবীন্দ্রনাথের একক মেজরটি থাকিলেও পার্লামেন্টটি বহু দলীয় ছিলো। রামমোহন, নিধুবাবু থেকে শুরু করে নজরুলের কীর্তন শুধু নয়- শুকনো পাতার নূপুর পায়ে অবধি ছিলো।
যেখানে তাহার বাবা রাম মোহনের গান শেষ করিয়া একেবারে নাচের তাল তুলিবার জন্যে নজরুলের শুকনো পাতার নূপুর পায়ে নিজের কণ্ঠে তুলিয়া আসর মাতাইতেছিলেন সেখানেও না গিয়া অনির্বান একাকী নিজের ঘরেই বসিয়া রহিল। তাহার একাকিত্ব দূর করিবার জন্যে বৌদি কারো হাতে চা না পাঠাইয়া নিজেই এক কাপ চা লইয়া আসিয়াছিলো। অনির্বান শুধু চেয়ার ছাড়িয়া বৌদির হাত হইতে চায়ের কাপটি লইয়া আবার বসিয়া পড়িলো। বৌদিও তাহার মুখ দেখিয়া বেশি কথা বলার সুযোগ পাইলো না শুধু বলিলো, পুঁজোর আগমনীর দিনে একাকি বসিয়া থাকিয়ো না। বাইরে সকলেই আনন্দ করিতেছে। তোমাকে লিপি, গপি সকলেই খুজিয়া গিয়াছে। অনির্বান নীরবে চায়ে চুমুক দেয়। পুঁজোর বাড়ির অনেকগুলো চাবি বৌদির আঁচলে তাই ইহার বেশি সময় সে অনির্বানকে কোন মতেই দিতে পারিলো না।
পুঁজার বাড়িতে সন্ধ্যার গানের আনন্দ’র রেশ কাটিলো। ওই বাড়ির মাথার ওপরের আকাশের বাতাস বহিয়া তখনও ব্রহ্ম সঙ্গীতের রেশ ছিলো কিনা তাহাও অনির্বানের মনে হইলো না। এমনকি কেন যেন তাহার ক্ষুধারও উদ্রেগ ঘটিতেছিলো না। তাহার পরেও মায়ের ডাকে তাহাকে যাইতে হইলো কারণ তাহার বাবা ও জ্যাঠামহাশয় তাহার জন্যে খাবার টেবিলে বসিয়া ডাক পাঠাইয়াছেন।
এ বাড়িতে একমাত্র সন্ধ্যা ছয়টার ভেতর তাহার বড় জ্যাঠামহাশয় ডিনার করিয়া নেন। কারণ তাহার স্বাস্থ্য। আর যিনি শতবর্ষে পা দিচ্ছেন তাহার ডিনার যে যৎসামান্য তাহা বলিবার কোন প্রয়োজন পড়ে না। অন্য দিকে তাহার বাবা ও অন্য জ্যাঠামহাশয়ের স্বাভাবিক রুটিন রেডিওতে কয়েকটি সংবাদ শেষ করিয়া, কিছুটা পড়াশুনা করিয়া রাত নয়টায় ডিনার শুরু করেন। বাড়িতে কোন উৎসব না থাকিলেই এই নিয়মেই চলে। আজ উৎসবের বাড়ি তাই এগারটা বাজিয়া গিয়াছে।
ডিনারে বসিয়া জ্যাঠামহাশয়ই প্রথম অনির্বানের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি জানিতে চান অনির্বান কি পড়াশুনার চাপে গান, আবৃত্তি, নাটক এগুলো ছাড়িয়া দিয়াছে? অনির্বান মৃদু হাসে। যাহার ভেতর দিয়ে প্রকাশ পায়, কিছুটা ভাটা পড়িলেও একেবারেই ছাড়েনি। তখন তাহার বাবা বলেন, তোমার কি এখন আর ওই মিশণারী স্কুলের সঙ্গে যোগাযোগ আছে? যাও কি সেখানে মাঝে মধ্যে? ওদের চার্চের গির্জায় এক ভদ্রলোকের গলা বড় সুন্দর। অনির্বান বলেন, উনি এখন ফাদার হইয়া অন্য গির্জায় চলিয়া গিয়াছেন। দুই বার গিয়াছি কিন্তু ওনার দেখা পাই নাই।
পুঁজার বাড়ি। কয়েক পদের নিরামিষ, লুচি আর সন্দেশে ডিনার শেষ হইয়া গেলে- অনির্বান তাহার নিজের রুমে আসে। গতরাতে তাহার রুমে তাহাকে তাহার দুই কাকাতো ভাইয়ের সঙ্গে শেয়ার করিয়া ঘুমাইতে হইয়াছিলো। পুঁজা বাড়িতে এটাই স্বাভাবিক। আজ তাহার রুমে কে কে আসিবে সে চিন্তা অনির্বানের তখনও মাথায় আসেনি। এমন সময় যিনি ঘুমানোর জন্যে সকল প্রস্তুতি লইয়া তাহার নরম বালিশটি সহ অনির্বানের রুমে আসিলেন তাহাকে দেখিয়া অনির্বান শুধু উঠিয়া দাঁড়াইলো না- অনেকটা আকুলিত স্বরে বলিলো, মা তুমি আমার সঙ্গে ঘুমাইবে? মা তাহার হাতখানি অনির্বানের মাথায় রাখিলেন। মায়ের সঙ্গে ছেলেবেলা হইতে অনির্বানের সময় খুব বেশি কাটেনি ঠিকই। তবে মা শুধু অনির্বানের কাছে তাহার মা নয়, তাহার আরধ্য দেবতাও। নিজের চিন্তায়, নিজের নির্ভরতায় সে মায়ের ওপরে আজো কোন স্রষ্টাকেও বসাতে পারেনি। জীবনে আর পারিবে কিনা তাহাও সে জানে না। তার এই ক্ষুদ্র জীবনেও অনেক ঝড় ঝাপটা পার হইতে হইয়াছে। সবখানেই নদীতে মাঝি যেমন ঝড়ের কবলে পড়িলে নদী ও ঝড়ের দেবতাকে স্মরণ করে- জীবনের ঝড়গুলোতে শুধু নয় দিনারম্ভে ও ঘুমাতে যাইবার আগে অনির্বানের মায়ের মুখটিই তাহার সামনে আসে। সেখানেই তাহার সকল নির্ভরতা।
বাড়িতে স্বাভাবিক সময়ে আসিলে সে মাকেই তাহার কাছে ঘুমাইতে বলে। উৎসবে তাহা বলিবার কোন অবকাশ থাকে না। এ সময়ে মায়ের ফুরসৎ কই? তাই যাহা তাহার কল্পনায় ছিলো না তাহা ঘটিবার ফলে অনির্বানের সারা দিনের সেই অজানা নেশাগ্রস্থতা সম্পূর্ণ কাটিয়া না গেলেও কেমন যেন মনটিতে দোলা লাগে। এবং মায়ের কোলের ভেতর একটু গুটি হইয়া তাহার ঘুমাইতে সময় লাগে না। অনির্বান দ্রুত ঘুমাইয়া গেলেও মা তাহার মাথা ভর্তি চুলগুলোর ভেতর হাত বুলাইতে বুলাইতে মনে করে তাহার নিজের বাবার মাথায়ও এমনই চুল ছিলো। অনির্বান ও তাহার মা এক সময়ে ঘুমাইয়া পড়ে।
অনির্বান দেখিতে পায় তাহার গায়ের সুর্যের আলো ক্রমেই উজ্জল হইয়া উঠিতেছে। শুধু উজ্জল নহে তাহার সঙ্গে একটা হালকা তাপও ছড়াইতেছে। যে তাপের ভেতর ফাল্গুনের হাওয়ার দোলা আছে। এই আলো ও হাওয়া মিলে অনির্বানকে যেন জাগাইয়া তুলিয়াছে, তাহার পা দ্রুত ওষুধি গাছ গুলোর ফাঁকে ফাঁকে যে পথ গড়িয়া উঠিয়াছে ওই পথ বাহিয়া এগিয়ে আসে পুকুর ঘাটের দিকে।
পুকুর ঘাটের রক্তজবা গাছটি দৈর্ঘে অনির্বানের মাথার ওপর। তাহার নুয়ে পড়া ডালটিতে থোকা থোকা রক্তজবা তখন অনির্বানের মাথার ওপর নামিয়া আসিয়াছে। কাঁচা লাল রক্তের মতো তাহার রঙ। রক্ত রঙা ওই ফুল গুলো কয়েক মুহূর্ত হইলেও অনির্বানের কালো চুলের ওপর একটি রক্ত রাঙা টোপর পরিয়ে দেয়। অন্যদিকে তাহার সামনে রাধাচূড়া গাছটি যা অর্বিবানের বুক সমান লম্বা হইবে না- সারা শরীর জুড়ে যাহার হলুদ ফুলে ভরা তাহার পাশে রাধা চুড়ার রঙকে সম্পূর্ন ঢাকিয়া দিবার ক্ষমতা রাখে যে মুখটি সে এবার তাহার সাগরের শঙ্খ আর সফেন মেলানো হাসি সারা মুখে ছড়াইয়া অনির্বানকে আহবান করে। পৃথিবীতে পাহাড়ের আহবানও বড় বড় পাথর ঠেকাইতে পারে- কিন্তু সাগরের আহবান ঠেকাইবার শক্তি আজো কেহ অর্জন করিতে পারে নাই। কারণ পাহাড় অনেক কঠিন শীলায় গঠিত আর সাগর তো কোমল জলের ধাত্রী- তাই কোমলের আহবান রুধিবার শক্তি স্রষ্টা কাউকেই দেয়নি। সেখানে অনির্বানের কীবা করিবার ছিলো। বরং সেই আহবানের স্রোতের টানে সে তাহার পাশে বসিয়া পড়ে।
না, তাহাদের মধ্যে কোন বাক্য বিনিময় হয় না। কেবল অনির্বান চাহিয়া চাহিয়া দেখিতে থাকে সুডৌল সোনালী দুইটি হাত, রোমান শিল্পির আঁকা আঙুল দিয়া একের পর এক রাধাচূড়া ফুলের দল ছিড়িতেছে পরম মমতায়। না, রাধাছূড়া গাছ কোন ব্যথা বোধ করিতেছে না। বরং সেও যেন ডালগুলো নুইয়ে দিয়া ফুলের দল তাহার হাতে তুলিয়া দিবার জন্যে ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছে।
তাহার অঞ্জলি রাধাচূড়া ফুলের পাপড়িতে ভরিয়া গেলে সে তাহার চোখের ঈশারায় অনির্বানকে অঞ্জলি পাতিতে বলে। অনির্বান নিতান্ত বাধ্য শিশুর মতোই তাহার অঞ্জলি পাতে। কিন্তু ফুলের দল নয় বরং ফুলের পাপড়ি ভর্তি অঞ্জলি তাহার অঞ্জলির ওপর স্থাপিত হয়। সে স্পর্শ্বে অনির্বানের সারা শরীরে সাগরের উদ্দাম স্রোত বহিয়া গেলেও সে শান্ত ভাবেই বসিয়া থাকে। তাহার পরে দুইটি অঞ্জলি মিলিত হয়ে রাধা চূড়ার দলগুলো পুকুরের নীল জলে ভাসাইয়া দেয়। জলের ওপর পাপড়িগুলো ধীরে ধীরে ছড়াইয়া যাইতে থাকে। আর জল থেকে উত্থিত দুটি অঞ্জলি এবার দুই ভাগে ভাগ হইয়া একে অপরের অঞ্জলির মধ্যে প্রবেশ করে।
তাহার পরে কে আগে হাত ছাড়িয়া দেয় সে মুহূর্ত চিহ্নিত হইলো না। তবে কাহারো কোন কথা বিনিময় হইলো না। শুধু নীরবে তাহারা পাশাপাশি কিছু দূর হাঁটিবার পরে একে অপরকে হারাইয়া ফেলিলো।
তাহারা যখন একে অপরকে হারাইয়া ফেলিলো তখন ধীর ধীরে নয় সহসা একটি অন্ধকার নামিয়া আসিলো – যেমন করিয়া সহসা বাতাস ফেলিয়া যায় শ্বাস কারো না কারো কানের পাশ দিয়া প্রাণ অবধি -তেমনি দ্রুত ঘটনাটি ঘটিয়া গেলো। সেই অন্ধকারকে অনির্বান মানিয়া লইতে না পারিয়া অন্ধকারের মধ্যেই তাহাকে খুঁজিতে লাগিলো দ্বিগবিদিক। আর সেই দিশেহারা অনির্বান তাহাকে খুঁজিতে খুঁজিতে যতক্ষণে পুঁজা মন্ডপে উপস্থিতি হইলো তখন চারপাশে ঘোর অন্ধকার থাকিলেও মন্ডপে যেন একটি উজ্জল আলো জ্বলিয়া উঠিয়াছে। কী এই আলো, কোথা হইতে আসিয়াছে তা বুঝিবার সময় পাইলো না অনির্বান। সেই আলোতে অনির্বান দেখিতে পায় ভাস্করের প্রতিমা ও তাহার প্রতিমা যেন এক হইয়া যাইতেছে। তাহাদের মুখের দিকে চাহিবার ক্ষমতা সে পায়না কেবলই দেখতে পায় এক গাছা দড়ি লইয়া মন্ডপের শক্ত কাঠে সেই প্রতিমা গলায় ফাঁস লাগাইয়া ঝুলিয়া পড়িল। অর্নিবান আর সহ্য করিতে পারে না। সে পাগলের মতো চিৎকার করিয়া জড়াইয়া ধরিতে গেলো গলায় দঁড়ি দিয়া তাহার যে প্রতিমা ঝুলিয়া আছে তাহাকে।
অনির্বান চিৎকার করিয়া “ প্রতিমা” বলিয়া ডাকিলেও তাহা গোঙানি ছাড়া আর কিছুই হইলো না। ত্রস্ত মা দ্রুত ধাক্কা দিয়া অনির্বানকে জাগাইলো। অনির্বানের সমস্ত শরীর ঘামে ভিজিয়া গিয়াছে। মা আঁচল দিয়া মুছিয়া দিবার জন্য ব্যস্ত হইলেন। অনির্বানের শরীর তখনও কাঁপিতেছে। আর সেই কাঁপন ধরা শরীর নিয়ে কম্পিত গলায় অনির্বান বলিলো, মা মন্ডপে চলো।
মা তাহার মাথায় আরেক হাতের তালু রাখিয়া বলিলেন, এই অন্ধকারে কেন মন্ডপে যাবে বাবা!