১১:৫৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

এনসিপি কি ‘মব’ দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে চায়?

  • Sarakhon Report
  • ০৫:১৮:২৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৪ জুলাই ২০২৫
  • 9

পাঁচই অগাস্টের পর থেকে বেশ কিছু ‘মবের’ ঘটনায় নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে, এর সঙ্গে সবশেষ সংযোজন পটিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু জাহেদ মো. নাজমুন নূরের প্রত্যাহারের ঘটনা।

প্রশ্ন উঠছে, একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে এনসিপির নেতা-কর্মীরা মব বা দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মতো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন কি না? অনেকে আবার এমন অভিযোগও করছেন যে, দলটি ক্ষমতা প্রদর্শনের একটি মাধ্যম হিসেবে মব ব্যবহার করছে।

যদিও এ ধরনের ঘটনায় মবকে ‘বিক্ষুব্ধ জনতা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন এনসিপির একাধিক নেতা। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দীর্ঘ সময় জনসাধারণকে যে দমন-পীড়ন করা হয়েছে, একে তার বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই দেখছেন তারা।

আবার দলটির কেউ কেউ বলছেন, দল হিসেবে গণতান্ত্রিক উপায়ে নিজেদের দাবি আদায়ের অধিকার এনসিপির আছে। তবে অনেকসময় মবের ঘটনায় অন্য রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্টতা থাকলেও এনসিপির সাথে তাদের মিলিয়ে প্রচারণা চালানো হচ্ছে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, মব ব্যবহার করে প্রতিপক্ষের ওপরে নিজের আধিপত্য তৈরি করা সহজ। ফলে অনেকেই একে অন্য রাজনৈতিক দলের ওপর এনসিপির চাপ প্রয়োগের একটি কৌশল হিসেবে দেখছেন।

তবে এ ধরনের কর্মকান্ড “কোনো রাজনৈতিক দলের পরিচয়ের সাথে যায় না” এবং একে “অপরাজনীতিও” বলছেন বিশ্লেষকদের কেউ কেউ।

গত ২৯শে মে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের রংপুরের বাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়

একাধিক মবের ঘটনায় এনসিপির সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ

গত মঙ্গলবার ছাত্রলীগের এক নেতাকে পুলিশে দিলেও কোনো মামলা না থাকায় তাকে গ্রেফতারে অপারগতা জানায় পটিয়া থানা। এনিয়ে বাগ্‌বিতণ্ডার এক পর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

পরে এনিয়ে এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব আরিফ সোহেল তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজে লেখেন “পটিয়া থানা মাটির সাথে মিশায়া দিতে হবে!”

এই ঘটনার জেরে বুধবার সকালে থানার ওসির অপসারণ ও দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেন এনসিপি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। একইদিন মধ্যরাতে ওসি আবু জাহেদ মো. নাজমুন নূরকে প্রত্যাহার করার খবর আসে।

এর আগে, গত ২৯শে মে রংপুরে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে। হামলার জন্য রংপুর জেলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন মি. কাদের।

যদিও অভিযুক্তদের দাবি সেই ঘটনায় তাদের ওপর আগে হামলা হয়েছিল।

একই মাসের ১৯ তারিখ ঢাকার ধানমন্ডিতে হাক্কানী পাবলিশার্সের প্রকাশক গোলাম মোস্তফার বাসার সামনে বিশৃঙ্খলা ও মব তৈরি করে স্লোগান দিতে থাকেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মী পরিচয়ে কয়েকজন যুবক।

এসময় পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ বলে মি. মোস্তফাকে গ্রেফতারের দাবি করলেও মামলা না থাকায় গ্রেফতার করা যাবে না বলে জানায় পুলিশ। এনিয়ে এক পর্যায়ে বাগ্‌বিতণ্ডায় জড়ালে তিনজনকে আটক করা হয়।

পরে পুলিশের কাছে মুচলেকা দিয়ে তাদের ছাড়িয়ে আনেন এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ।

অবশ্য এনিয়ে দল থেকে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশও দেওয়া হয়। ভুল স্বীকার এবং সংশ্লিষ্টদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা না থাকায় তা প্রত্যাহার করা হয়।

এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব

যা বলছে দলটির নেতারা

কিছুদিন আগে একটি জাতীয় গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম মবকে ‘বিক্ষুব্ধ জনতা’ হিসেবে উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, “সঠিক কর্মসূচি ও নেতৃত্ব না থাকার কারণে এদের নানাজন নানাভাবে ব্যবহার করেছে, ডাইভার্ট করেছে, নিজেদের ব্যক্তিগত এজেন্ডা বা গোষ্ঠী এজেন্ডায় তাদের ব্যবহার করা হয়েছে। এটা আমাদেরও সীমাবদ্ধতা”।

বৃহস্পতিবার বিবিসি বাংলার সাথে আলাপকালে অনেকটা একই কথা বলেন দলটির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব।

তার মতে, ১৫ বছর একটা সমাজের মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার হরণ করার কারণে এর বড় একটি অংশ সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি আস্থাহীন হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রের প্রতি তাদের ক্ষোভ প্রশমিত হয়নি।

রেভ্যুলশনারি ফোর্স আকারে সোসাইটিতে থাকা ওই গোষ্ঠী এনসিপিতেও আছে বলে জানান তিনি। বলেন, “দলের কিছু কিছু মানুষ এখনও রেভ্যুলশনারি চিন্তা ধারণ করে”।

রাজনৈতিক নেতৃত্বের মাধ্যমে তাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসার চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি।

তবে এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব মুশফিক উস সালেহীন মবে তাদের দলের নেতা-কর্মীদের জড়িত থাকার অভিযোগ মানতে রাজি নন।

তার মতে, রাজনৈতিক দল হিসেবে এনসিপি যেকোনো দাবি-দাওয়া নিজেদের নামেই প্রকাশ করে এবং নিজেদের ব্যানারেই কর্মসূচি পালন করে। ফলে “অন্য কিছুর আড়ালে দলীয় কার্যক্রম চালানোর প্রয়োজন নেই”, বলে মন্তব্য করেন মি. সালেহীন।

এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব মুশফিক উস সালেহীন

মুশফিক উস সালেহীন বলছেন, রাজনৈতিক গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে যদি কোনো ঘটনা ঘটে, তাকে আর মব বলার সুযোগ নেই। আর যেকোনো রাজনৈতিক দলের জন্যেই যৌক্তিক দাবি নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলন পরিচালনা করে আদায়ের চেষ্টা করা স্বাভাবিক।

এর আগে, গত ২২শে জুন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদার গলায় জুতার মালা পরিয়ে তাকে লাঞ্ছিত করা হয়। সেই ঘটনায় বিএনপির নেতাকর্মীদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠে।

তার দুইদিন পর খুলনায় সাবেক এক এসআইকে মারধর করে পুলিশের হাতে তুলে দেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। পরে তাকে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ তুলে কেএমপি কমিশনারের অপসারণের দাবিতে ‘সচেতন ছাত্র-জনতা’র ব্যানারে কেএমপি সদর দপ্তর ঘেরাও করা হয়।

মুশফিক উস সালেহীন বলছেন, এমন নানা ঘটনায় অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্টতা থাকলেও উদ্দেশ্যমূলকভাবে বারবার এনসিপির নাম ব্যবহার করা হচ্ছে।

“মবের সাথে এনসিপিকে মিলিয়ে সারাদেশের সব ঘটনার দায় এনসিপির ওপর চাপানোর চেষ্টা হচ্ছে। এনসিপির বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন চালানো হচ্ছে”, বলেন তিনি।

গণঅভ্যুত্থানের পর প্রেশার গ্রুপ হিসেবে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেরই একটি অংশ থেকে তৈরি হয়েছে নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি। ফলে রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর পদস্থ নেতা-কর্মীরা কি এই ধরনের কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারেন?

এমন প্রশ্নের জবাবে মি. আদীব বলেন, “নীতিগতভাবে সেটা হয়তো যায় না। কিন্তু একইসাথে পুলিশ গণহত্যাকারী কিংবা ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের ধরার ক্ষেত্রে সক্রিয়তা দেখায় না, তখন তার প্রতি ক্ষোভটা পড়ে”।

একইসাথে এসব ঘটনায় “দল আকারে এনসিপি হাজির নয়” বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

আর জান-মালের ক্ষতি না করে দাবি আদায়ে এনসিপির নেতা-কর্মীদের প্রতি নির্দেশনা আছে বলে জানান মি. সালেহীন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাব্বির আহমেদ

“এগুলো হচ্ছে অপরাজনীতি”

মব নিয়ে নাহিদ ইসলামের বক্তব্যের তিনদিন আগে অনেকটা একই সুরে কথা বলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।

“আপনারা যেগুলোকে মব বলছেন, আমি সেগুলোকে মব বলছি না। এটা প্রেসার। যারা ১৫ বছর ধরে নিপীড়িত হয়েছেন, তারা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন”, বলেছিলেন তিনি।

“এনসিপিও একই লাইনে আছে” উল্লেখ করে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, “আমরা সবাই বলছি যে, আইনের শাসন চাই, আইনের শাসনের অপপ্রয়োগ হচ্ছে। আবার আমরা নিজের হাতে আইন তুলে নিচ্ছি”।

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাব্বির আহমেদ মনে করেন, মবের পেছনে “সরকারের প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে”।

“মবকে ব্যবহার করা হয় সুবিধাতো। মব ব্যবহার করে প্রতিপক্ষের ওপরে নিজের আধিপত্য তৈরি করতে সহজ হয়। ভয় পাবে সবাই। তারা চাচ্ছে এই ভয়টা ধরে রাখতে এবং আমার মনে হয় এর পেছনে সরকারের ইন্ধন থাকতে পারে”, বলেন অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ।

এছাড়াও এনসিপি “আইনের শাসনের উর্ধ্বে উঠে নিজেরাই আইন প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে” বলেও মন্তব্য করেন এই বিশ্লেষক। বলেন, “এনসিপি ফ্যাসিস্ট দলের মতো আত্মপ্রকাশ করছে বলে আমার মনে হচ্ছে”।

একইসাথে “এটি বিএনপি ও জামায়াতকে হুমকির মধ্যে রাখার কৌশল হতে পারে। তবে রাজনৈতিক দলের পরিচয়ের সাথে এটা (মব) যায় না এবং রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড এটা হতে পারে না”

মবকে দলীয়ভাবে ব্যবহারের চেষ্টা করলে তা “দলের বিকাশের চাইতে, দল ধ্বংসের পথে সহায় হবে”, যা অত্যন্ত “অনাকাঙ্ক্ষিত” বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এদিকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ ধরনের কর্মকাণ্ড অনেক পুরাতন বলে জানান রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ।

মি. আহমদ বলেন, এরশাদের আমলে ‘স্বৈরাচার এরশাদের দোসর’ হবার অভিযোগে শহীদ মিনারের সামনে আ স ম আব্দুর রবের শার্ট ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল। তত্ত্বাবধয়াক সরকারের আমলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য জেনারেল মাহবুবকে ‘এক-এগারোর দোসর’ বলে হেনস্তা করা হয়।

“যখন রাজনীতি থাকে না, তখন রাজনীতির নামে এগুলো চলে। এগুলো রাজনীতি নয়, এগুলো হচ্ছে অপরাজনীতি”, বলেন এই বিশ্লেষক।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ

এনসিপি কি ‘মব’ দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে চায়?

০৫:১৮:২৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৪ জুলাই ২০২৫

পাঁচই অগাস্টের পর থেকে বেশ কিছু ‘মবের’ ঘটনায় নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে, এর সঙ্গে সবশেষ সংযোজন পটিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু জাহেদ মো. নাজমুন নূরের প্রত্যাহারের ঘটনা।

প্রশ্ন উঠছে, একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে এনসিপির নেতা-কর্মীরা মব বা দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মতো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন কি না? অনেকে আবার এমন অভিযোগও করছেন যে, দলটি ক্ষমতা প্রদর্শনের একটি মাধ্যম হিসেবে মব ব্যবহার করছে।

যদিও এ ধরনের ঘটনায় মবকে ‘বিক্ষুব্ধ জনতা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন এনসিপির একাধিক নেতা। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দীর্ঘ সময় জনসাধারণকে যে দমন-পীড়ন করা হয়েছে, একে তার বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই দেখছেন তারা।

আবার দলটির কেউ কেউ বলছেন, দল হিসেবে গণতান্ত্রিক উপায়ে নিজেদের দাবি আদায়ের অধিকার এনসিপির আছে। তবে অনেকসময় মবের ঘটনায় অন্য রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্টতা থাকলেও এনসিপির সাথে তাদের মিলিয়ে প্রচারণা চালানো হচ্ছে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, মব ব্যবহার করে প্রতিপক্ষের ওপরে নিজের আধিপত্য তৈরি করা সহজ। ফলে অনেকেই একে অন্য রাজনৈতিক দলের ওপর এনসিপির চাপ প্রয়োগের একটি কৌশল হিসেবে দেখছেন।

তবে এ ধরনের কর্মকান্ড “কোনো রাজনৈতিক দলের পরিচয়ের সাথে যায় না” এবং একে “অপরাজনীতিও” বলছেন বিশ্লেষকদের কেউ কেউ।

গত ২৯শে মে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের রংপুরের বাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়

একাধিক মবের ঘটনায় এনসিপির সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ

গত মঙ্গলবার ছাত্রলীগের এক নেতাকে পুলিশে দিলেও কোনো মামলা না থাকায় তাকে গ্রেফতারে অপারগতা জানায় পটিয়া থানা। এনিয়ে বাগ্‌বিতণ্ডার এক পর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

পরে এনিয়ে এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব আরিফ সোহেল তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজে লেখেন “পটিয়া থানা মাটির সাথে মিশায়া দিতে হবে!”

এই ঘটনার জেরে বুধবার সকালে থানার ওসির অপসারণ ও দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেন এনসিপি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। একইদিন মধ্যরাতে ওসি আবু জাহেদ মো. নাজমুন নূরকে প্রত্যাহার করার খবর আসে।

এর আগে, গত ২৯শে মে রংপুরে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে। হামলার জন্য রংপুর জেলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন মি. কাদের।

যদিও অভিযুক্তদের দাবি সেই ঘটনায় তাদের ওপর আগে হামলা হয়েছিল।

একই মাসের ১৯ তারিখ ঢাকার ধানমন্ডিতে হাক্কানী পাবলিশার্সের প্রকাশক গোলাম মোস্তফার বাসার সামনে বিশৃঙ্খলা ও মব তৈরি করে স্লোগান দিতে থাকেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মী পরিচয়ে কয়েকজন যুবক।

এসময় পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ বলে মি. মোস্তফাকে গ্রেফতারের দাবি করলেও মামলা না থাকায় গ্রেফতার করা যাবে না বলে জানায় পুলিশ। এনিয়ে এক পর্যায়ে বাগ্‌বিতণ্ডায় জড়ালে তিনজনকে আটক করা হয়।

পরে পুলিশের কাছে মুচলেকা দিয়ে তাদের ছাড়িয়ে আনেন এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ।

অবশ্য এনিয়ে দল থেকে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশও দেওয়া হয়। ভুল স্বীকার এবং সংশ্লিষ্টদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা না থাকায় তা প্রত্যাহার করা হয়।

এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব

যা বলছে দলটির নেতারা

কিছুদিন আগে একটি জাতীয় গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম মবকে ‘বিক্ষুব্ধ জনতা’ হিসেবে উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, “সঠিক কর্মসূচি ও নেতৃত্ব না থাকার কারণে এদের নানাজন নানাভাবে ব্যবহার করেছে, ডাইভার্ট করেছে, নিজেদের ব্যক্তিগত এজেন্ডা বা গোষ্ঠী এজেন্ডায় তাদের ব্যবহার করা হয়েছে। এটা আমাদেরও সীমাবদ্ধতা”।

বৃহস্পতিবার বিবিসি বাংলার সাথে আলাপকালে অনেকটা একই কথা বলেন দলটির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব।

তার মতে, ১৫ বছর একটা সমাজের মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার হরণ করার কারণে এর বড় একটি অংশ সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি আস্থাহীন হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রের প্রতি তাদের ক্ষোভ প্রশমিত হয়নি।

রেভ্যুলশনারি ফোর্স আকারে সোসাইটিতে থাকা ওই গোষ্ঠী এনসিপিতেও আছে বলে জানান তিনি। বলেন, “দলের কিছু কিছু মানুষ এখনও রেভ্যুলশনারি চিন্তা ধারণ করে”।

রাজনৈতিক নেতৃত্বের মাধ্যমে তাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসার চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি।

তবে এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব মুশফিক উস সালেহীন মবে তাদের দলের নেতা-কর্মীদের জড়িত থাকার অভিযোগ মানতে রাজি নন।

তার মতে, রাজনৈতিক দল হিসেবে এনসিপি যেকোনো দাবি-দাওয়া নিজেদের নামেই প্রকাশ করে এবং নিজেদের ব্যানারেই কর্মসূচি পালন করে। ফলে “অন্য কিছুর আড়ালে দলীয় কার্যক্রম চালানোর প্রয়োজন নেই”, বলে মন্তব্য করেন মি. সালেহীন।

এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব মুশফিক উস সালেহীন

মুশফিক উস সালেহীন বলছেন, রাজনৈতিক গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে যদি কোনো ঘটনা ঘটে, তাকে আর মব বলার সুযোগ নেই। আর যেকোনো রাজনৈতিক দলের জন্যেই যৌক্তিক দাবি নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলন পরিচালনা করে আদায়ের চেষ্টা করা স্বাভাবিক।

এর আগে, গত ২২শে জুন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদার গলায় জুতার মালা পরিয়ে তাকে লাঞ্ছিত করা হয়। সেই ঘটনায় বিএনপির নেতাকর্মীদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠে।

তার দুইদিন পর খুলনায় সাবেক এক এসআইকে মারধর করে পুলিশের হাতে তুলে দেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। পরে তাকে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ তুলে কেএমপি কমিশনারের অপসারণের দাবিতে ‘সচেতন ছাত্র-জনতা’র ব্যানারে কেএমপি সদর দপ্তর ঘেরাও করা হয়।

মুশফিক উস সালেহীন বলছেন, এমন নানা ঘটনায় অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্টতা থাকলেও উদ্দেশ্যমূলকভাবে বারবার এনসিপির নাম ব্যবহার করা হচ্ছে।

“মবের সাথে এনসিপিকে মিলিয়ে সারাদেশের সব ঘটনার দায় এনসিপির ওপর চাপানোর চেষ্টা হচ্ছে। এনসিপির বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন চালানো হচ্ছে”, বলেন তিনি।

গণঅভ্যুত্থানের পর প্রেশার গ্রুপ হিসেবে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেরই একটি অংশ থেকে তৈরি হয়েছে নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি। ফলে রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর পদস্থ নেতা-কর্মীরা কি এই ধরনের কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারেন?

এমন প্রশ্নের জবাবে মি. আদীব বলেন, “নীতিগতভাবে সেটা হয়তো যায় না। কিন্তু একইসাথে পুলিশ গণহত্যাকারী কিংবা ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের ধরার ক্ষেত্রে সক্রিয়তা দেখায় না, তখন তার প্রতি ক্ষোভটা পড়ে”।

একইসাথে এসব ঘটনায় “দল আকারে এনসিপি হাজির নয়” বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

আর জান-মালের ক্ষতি না করে দাবি আদায়ে এনসিপির নেতা-কর্মীদের প্রতি নির্দেশনা আছে বলে জানান মি. সালেহীন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাব্বির আহমেদ

“এগুলো হচ্ছে অপরাজনীতি”

মব নিয়ে নাহিদ ইসলামের বক্তব্যের তিনদিন আগে অনেকটা একই সুরে কথা বলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।

“আপনারা যেগুলোকে মব বলছেন, আমি সেগুলোকে মব বলছি না। এটা প্রেসার। যারা ১৫ বছর ধরে নিপীড়িত হয়েছেন, তারা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন”, বলেছিলেন তিনি।

“এনসিপিও একই লাইনে আছে” উল্লেখ করে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, “আমরা সবাই বলছি যে, আইনের শাসন চাই, আইনের শাসনের অপপ্রয়োগ হচ্ছে। আবার আমরা নিজের হাতে আইন তুলে নিচ্ছি”।

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাব্বির আহমেদ মনে করেন, মবের পেছনে “সরকারের প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে”।

“মবকে ব্যবহার করা হয় সুবিধাতো। মব ব্যবহার করে প্রতিপক্ষের ওপরে নিজের আধিপত্য তৈরি করতে সহজ হয়। ভয় পাবে সবাই। তারা চাচ্ছে এই ভয়টা ধরে রাখতে এবং আমার মনে হয় এর পেছনে সরকারের ইন্ধন থাকতে পারে”, বলেন অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ।

এছাড়াও এনসিপি “আইনের শাসনের উর্ধ্বে উঠে নিজেরাই আইন প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে” বলেও মন্তব্য করেন এই বিশ্লেষক। বলেন, “এনসিপি ফ্যাসিস্ট দলের মতো আত্মপ্রকাশ করছে বলে আমার মনে হচ্ছে”।

একইসাথে “এটি বিএনপি ও জামায়াতকে হুমকির মধ্যে রাখার কৌশল হতে পারে। তবে রাজনৈতিক দলের পরিচয়ের সাথে এটা (মব) যায় না এবং রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড এটা হতে পারে না”

মবকে দলীয়ভাবে ব্যবহারের চেষ্টা করলে তা “দলের বিকাশের চাইতে, দল ধ্বংসের পথে সহায় হবে”, যা অত্যন্ত “অনাকাঙ্ক্ষিত” বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এদিকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ ধরনের কর্মকাণ্ড অনেক পুরাতন বলে জানান রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ।

মি. আহমদ বলেন, এরশাদের আমলে ‘স্বৈরাচার এরশাদের দোসর’ হবার অভিযোগে শহীদ মিনারের সামনে আ স ম আব্দুর রবের শার্ট ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল। তত্ত্বাবধয়াক সরকারের আমলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য জেনারেল মাহবুবকে ‘এক-এগারোর দোসর’ বলে হেনস্তা করা হয়।

“যখন রাজনীতি থাকে না, তখন রাজনীতির নামে এগুলো চলে। এগুলো রাজনীতি নয়, এগুলো হচ্ছে অপরাজনীতি”, বলেন এই বিশ্লেষক।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ