ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় এমন এক নাম, যিনি চিকিৎসা, রাজনীতি, সমাজসেবা এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সমস্ত ক্ষেত্রে অসামান্য ছাপ রেখেছেন। একাধারে তিনি চিকিৎসা জগতে একজন মহান মানুষ, ব্রিটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং স্বাধীন ভারতের অন্যতম সফল প্রশাসক হিসেবে খ্যাত। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর প্রায় দেড় দশকের শাসনকালে রাজ্যের নগর পরিকল্পনা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং অর্থনৈতিক পুনর্গঠন—সবকিছুতেই তাঁর ছাপ অমলিন।
তবে তাঁর জীবনের একটি দিক বিশেষভাবে আলোচিত—তিনি পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারকে এক প্রদেশ করার জন্য একটি অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক পরিকল্পনা করেছিলেন। লক্ষ্য ছিল কলকাতার শিল্পকে বিহারের কাঁচামালের ওপর নির্ভর করে টিকিয়ে রাখা। কিন্তু রাজনৈতিক বিরোধ, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীদের অর্থনৈতিক অজ্ঞতা ও সংকীর্ণতা এই দূরদর্শী প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দেয়। এই প্রসঙ্গটি ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসে এক বড় ট্র্যাজেডি হিসেবে বিবেচিত হয়।
শৈশব ও শিক্ষা
ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের জন্ম ১৮৮২ সালের ১ জুলাই বিহারের (তৎকালীন বাংলার অন্তর্ভুক্ত) পাটনায়। তাঁর বাবা ছিলেন একজন সরকারি কর্মচারী এবং ব্রাহ্মসমাজের অনুরাগী। ছোটবেলা থেকেই শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনযাপন, শিক্ষার প্রতি গভীর মনোযোগ এবং মানবকল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করার প্রবণতা তাঁর মধ্যে গড়ে ওঠে।
তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়েন এবং গণিত ও রসায়নে ডিগ্রি নেন। এরপর কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাস করেন। সেসময় ভারতীয়দের জন্য মেডিক্যাল কলেজে পড়া সহজ ছিল না—ব্রিটিশ শাসন ছিল বৈষম্যমূলক। কিন্তু তিনি প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে চমৎকার ফল করেন।
বিলেত যাত্রা ও চিকিৎসাবিদ্যায় সাফল্য
চিকিৎসা শাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রির জন্য তিনি ইংল্যান্ড যান। সেখানকার রয়্যাল কলেজ অফ ফিজিশিয়ান্স এবং রয়্যাল কলেজ অফ সার্জন্স থেকে মাত্র দুই বছরে দুটি কঠিন ডিগ্রি অর্জন করেন—যা আজও এক কিংবদন্তি। একাধিকবার তাঁর আবেদনে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু অদম্য মানসিক শক্তি নিয়ে তিনি আবার আবেদন করেন। অবশেষে ব্রিটেনের মেডিক্যাল মহলে তিনি একজন দক্ষ ভারতীয় চিকিৎসক হিসেবে স্বীকৃতি পান।
চিকিৎসক হিসেবে অসাধারণ কাজ
কলকাতায় ফিরে এসে তিনি মেডিক্যাল প্র্যাকটিস শুরু করেন। কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্য ছিল শুধুই অর্থ উপার্জন নয়। তিনি ছিলেন দয়ার্দ্র হৃদয়ের মানুষ। গরিব রোগীদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা দিতেন। তাঁর কক্ষের বাইরে রোগীদের লাইন লেগে থাকত।
তিনি সারা বাংলার চিকিৎসকদের কাছে এক আদর্শ হয়ে ওঠেন। ভারতের প্রথম সারির কিছু হাসপাতালে (যেমন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ) অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই পরবর্তী প্রজন্মের নামকরা ডাক্তার হয়েছেন।
একটি বিশেষ ঘটনা প্রচলিত আছে—একবার রাত দুইটায় তাঁর দরজায় কড়া নাড়েন এক দরিদ্র মা, যার সন্তান প্রচণ্ড জ্বরে কাতর। বিধানবাবু সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে যান, তাকে চিকিৎসা করে বাঁচিয়ে আনেন। এ ধরনের অজস্র ঘটনা তাঁর জীবনের অংশ।
ব্রিটিশ-বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ভূমিকা
ডা. বিধান রায় শুধু চিকিৎসক নন, ছিলেন কংগ্রেসের সক্রিয় নেতা। ব্রিটিশ-বিরোধী অসহযোগ আন্দোলন, সিভিল ডিসঅবিডিয়েন্স মুভমেন্ট—সবখানেই তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
গান্ধীর ডাকে তিনি বিদেশি পোশাক বর্জন করেন এবং খদ্দর পরতেন। চিকিৎসা শিবিরে জাতীয়তাবাদী প্রচার চালাতেন। পুলিশের চোখে তিনি সন্দেহের পাত্রী ছিলেন। বহুবার তাঁকে নজরদারির আওতায় রাখা হয়েছিল।
স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিল নীরব কিন্তু অত্যন্ত প্রভাবশালী। ডাক্তার হিসেবে তাঁর জনপ্রিয়তা, নৈতিক সাহস এবং স্বচ্ছ ভাবমূর্তি তাঁকে জনমানসে এক বীরের মর্যাদা দিয়েছিল।
কলকাতার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ
স্বাধীনতার পরে ১৯৪৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হন। সেই সময় দেশভাগের ভয়াবহ শরণার্থী সঙ্কট পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র। অবিভক্ত বাংলার পূর্ব অংশ থেকে লাখ লাখ শরণার্থী কলকাতায় এবং পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতে এসে ভিড় করেন। খাদ্য, বাসস্থান, চাকরি—সবকিছুতেই ভয়াবহ চাপ তৈরি হয়।
বিধান রায় ছিলেন এক দূরদর্শী প্রশাসক। তিনি শরণার্থী পুনর্বাসনের জন্য নতুন নতুন নগর প্রকল্প হাতে নেন। কল্যাণী, দুর্গাপুর, আশোকনগর, হাবড়া—এই নতুন শহরগুলো তাঁর পরিকল্পনায় তৈরি হয়। তিনি কলকাতাকে বাঁচাতে নিউ আলিপুর, সল্টলেক (বিধাননগর) গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেন।
দুর্গাপুর ইস্পাত নগরীর নকশা, শিল্প-অর্থনীতির বিকেন্দ্রীকরণ, বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি, শিক্ষা-স্বাস্থ্য পরিকাঠামো—সবখানেই তাঁর সুনির্দিষ্ট অবদান রয়েছে।
স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বিপ্লব
তাঁর শাসনকালে মেডিক্যাল কলেজ, হাসপাতাল, নার্সিং ট্রেনিং স্কুলের ব্যাপক সম্প্রসারণ হয়। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ, আর জি কর, সিএনআই, এনআরএসসহ বিভিন্ন হাসপাতাল আধুনিক হয়। গরিব মানুষের জন্য সরকারি হাসপাতালে বিনা পয়সার ওষুধ এবং চিকিৎসা চালু হয়।
শিক্ষায় তাঁর অবদানও গুরুত্বপূর্ণ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে আধুনিক রূপ দেন। বিভিন্ন বিজ্ঞান কলেজ ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। আজ যেসব স্কুল-কলেজ পশ্চিমবঙ্গের গর্ব, তার অনেকগুলোই তাঁর সময়ের দান।
বিহার-পশ্চিমবঙ্গ এক প্রদেশ করার স্বপ্ন
তাঁর জীবনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অথচ ব্যর্থ অধ্যায় এই পরিকল্পনা। বিধান রায় বুঝেছিলেন, স্বাধীনতার পর বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গ দুই আলাদা রাজ্যে ভাগ হওয়ায় অর্থনৈতিকভাবে দুই প্রদেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কলকাতার শিল্পের জন্য বিহারের খনি ও খনিজ সম্পদ ছিল অপরিহার্য কাঁচামাল। অথচ আলাদা প্রশাসনিক সীমা, শুল্ক নীতি, রেলপথ ও নৌপথের সমস্যায় এই যোগসূত্র ক্রমশ দুর্বল হয়ে যাচ্ছিল।
বিধান রায় প্রস্তাব করেছিলেন—বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গ মিলে এক প্রদেশ করা হোক, যাতে শিল্পোন্নয়ন, খনিজ সম্পদ শাসন, জল-বিদ্যুৎ বণ্টন এবং পরিবহন নীতি যৌথভাবে হয়। এই পরিকল্পনা আজকের দিনের দৃষ্টিতে অবিশ্বাস্যভাবে আধুনিক ছিল।
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী দলগুলো তখন এই প্রস্তাবকে ‘পুঁজিপতিদের ষড়যন্ত্র’ বলে প্রত্যাখ্যান করে। তাদের অর্থনৈতিক জ্ঞান সীমিত ছিল এবং তারা শিল্পায়নের এই যৌক্তিক ভিত্তি বুঝতে পারেনি। বিহারের নেতারাও আঞ্চলিক অহংকারে সম্মত হননি। ফলে এই দূরদর্শী প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
এই ব্যর্থতার ফল ছিল মারাত্মক। কলকাতার বহু শিল্প ধুঁকতে থাকে, কাঁচামাল সরবরাহ ব্যাহত হয়, রেলভাড়া ও শুল্কের বেড়াজাল তৈরি হয়। পরবর্তী দশকে পশ্চিমবঙ্গের শিল্প-পুনর্জাগরণ আর সম্ভব হয়নি।
মানবিক চিকিৎসক রূপে কিছু অনন্য দৃষ্টান্ত
ডা. রায় নিজের উপার্জনের একটা বড় অংশ দান করতেন। কলকাতায় ‘বিধান সেবা সদন’ নামে দাতব্য ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করেন। গরিব রোগীদের বিনা পয়সায় ওষুধ দিতেন। এমনকি মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালেও তাঁর চেম্বার খোলা থাকত, রোগীরা আসতেন—তিনি সাধ্যমতো সেবা করতেন।
একবার তাঁরই মন্ত্রিসভার এক সহকর্মী রাত্রে ফোন করে জানান—গরিব মানুষের বাচ্চা খুব অসুস্থ। বিধান রায় নিজে গাড়ি নিয়ে গিয়ে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করান।
তিনি বলতেন—‘‘ডাক্তারি পেশা কেবল পয়সার জন্য নয়, এটা সেবা।’’
তাঁর মৃত্যুর দিন: এক কিংবদন্তির অবসান
১ জুলাই ১৯৬২, নিজের জন্মদিনেই তিনি প্রয়াত হন। ভারত সরকার তাঁকে ‘ভারত রত্ন’ প্রদান করে। তাঁর জন্মদিন আজও ভারতে ‘ডাক্তার দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।
উপসংহার
ডা. বিধানচন্দ্র রায় শুধু একজন চিকিৎসক ছিলেন না—তিনি ছিলেন একজন সমাজদ্রষ্টা, রাজনীতিক, দূরদর্শী অর্থনীতিবিদ এবং মানবিক নেতা। তাঁর মতো মানুষ আজও সব দেশের মানুষের প্রেরণার বাতিঘর ।