শশাঙ্ক মণ্ডল
লবণ
তৃতীয় অধ্যায়
ব্রিটিশরাজত্বের সূচনাপর্বে বাংলার শিল্প-বাণিজ্যে লবণের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। লবণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভারতের পরাধীনতা ও স্বাধীনতার ইতিহাস। মীরকাশিমের বিরুদ্ধে ১৭৬২ খ্রীষ্টাব্দে লবণ আইন ভঙ্গের মধ্য দিয়ে পূর্বভারতে প্রত্যক্ষভাবে ব্রিটিশ রাজত্বের শুরু হয় আর ১৯৩০ খ্রীষ্টাব্দে পশ্চিমভারতে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে লবণ আইন ভঙ্গের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার প্রস্তাব গ্রহণ করে জাতীয় কংগ্রেস। লবণের ইতিহাস তাই অশ্রুলবণাক্ত আমাদের দেশের মানুষের কান্না ঘাম রক্তের সঙ্গে মিশে আছে।
সুপ্রাচীন কাল থেকে বাংলার সমুদ্রতীরের জেলাগুলিতে লবণ উৎপাদিত হত। প্রাচীন ভূমিদানপত্রে ‘সলবণ ভূমির’ উল্লেখ রয়েছে। কাশ্মীরি বণিকরা বাংলা থেকে লবণ সংগ্রহ করতেন -লবণ উৎপাদনের অগ্রিম দাদনের মধ্য দিয়ে। বাংলা থেকে প্রতিবছর প্রচুর লবণ কাশীতে যেত এবং সেখান থেকে অযোধ্যা বুন্দেলখণ্ড নেপালে চালান করা হত। (১৭) ১৭৫৭-৫৮ সালে বাংলাদেশে ৮৫০০০ টন থেকে ৯৫০০০ টন লবণ তৈরি হয়েছিল। ১৭৬০ এ ২৪ পরগণার লবণের সমগ্র বাণিজ্য কোম্পানির হস্তগত হয় এবং ১৭৬৫ এর মধ্যে চট্টগ্রাম বর্ধমান, মেদিনীপুর এর বাণিজ্য কোম্পানির হাতে চলে আসায় আমাদের দেশের বণিকেরা সে যুগের বাণিজ্যের এক উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্র হতে বিদায় নিতে বাধ্য হয়।
সমগ্র বাংলার লবণ উৎপাদনের অর্ধেক তমলুক হিজলীতে হত আর তিনভাগের এক ভাগ উৎপাদিত হত সুন্দরবনের অভ্যন্তরে বারুইপুর-বসিরহাটের রায়মঙ্গল মহলগুলিতে। সমগ্র অষ্টাদশ শতাব্দী জুড়ে রায়মঙ্গল সল্ট এজেন্সি ছিল নদীয়া জেলার অন্তর্গত। সুন্দরবন এবং মেদিনীপুর এর লবণ উৎপাদন একত্রিত করলে বাংলার সমগ্র উৎপাদনের ৮০ শতাংশ এখানেই উৎপাদিত হত। নবাব সরকারের আমলে
লবণ তৈরির জন্য ২ শতাংশ খাজনা দিতে হত মুসলমানদের আর হিন্দুদের ক্ষেত্রে তা ছিল ৫ শতাংশ। মোগলযুগেও লবণের একচেটিয়া ব্যবসা মুষ্টিমেয় বণিকের হাতে কেন্দ্রীভূত ছিল এবং এদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি সে যুগে খুব বেশি ছিল। ১৭২৭ এবং ১৭৪১ খ্রীষ্টাব্দে লবণের ব্যবসা নিয়ে বাংলার তৎকালীন সরকারের সঙ্গে ইংরেজকোম্পানির বিরোধ উচ্চতম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। লবণের ব্যবসাকে কেন্দ্র করে কোম্পানির লোকেরা সরকারকে দু-ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে থাকে।
সরকার অভ্যন্তরীণ খাজনা থেকে বঞ্চিত হত আর এদেশীয় বণিকরা অভ্যন্তরীণ বাজারে অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হত। বাদশাহি ফরমানের আড়ালে বাংলার অর্থনৈতিক ইতিহাসে ইংরাজ বণিকরা এক দারুণ সংকটের সৃষ্টি করে। আলিবর্দির সময়ে ইংরেজ বণিকরা পাঁচ ছয় হাজার মণের চল্লিশখানা নৌকায় করে আসামে প্রতি বছর লবণ পাঠাত। লাভ হত অসাধারণ। এমনকি শতকরা ২০০ ভাগের ওপর। (১৯) দেশিয় বণিকরা মালঙ্গীদের দাদন দিত এই শর্তে যে বছরের এক নির্দিষ্ট সময়ে তারা লবণ সরবরাহ করবে।