স্বদেশ রায়
মতিয়া চৌধুরির সঙ্গে সম্পর্কটা রাজনীতিক ও সাংবাদিকের মধ্যে যে সম্পর্ক হয় বা যেমন ভাবে শুরু হয় সেভাবে হয়নি। কারণ, তার জীবনের বন্ধু বা সঙ্গী বজলুর রহমান আমাদের শুধু প্রিয় নয়- পথ প্রদর্শক সাংবাদিক ছিলেন। বজলুভাই এর হাত ধরেই মতিয়া চৌধুরি’র সঙ্গে ঘনিষ্টতা শুরু।
মতিয়া চৌধুরি নিজে্ও সাংবাদিকতা করেছেন। বজলুর রহমান বাংলাদেশে চিরকাল যে সব সাংবাদিকদের নাম স্মরণ করা হবে, যেমন- মানিক মিঞ্রা, জহুর হোসেন চৌধুরী থেকে আতাউস সামাদ তাদেরই একজন। তারপরেও মতিয়া চৌধুরি যে খুব সাংবাদিক ফ্রেন্ডলি রাজনীতিক ছিলেন তা বলা যাবে না। তাই সাংবাদিকতা নিয়ে তার সঙ্গে আলাপ অনেক সময় সযতনে এড়িয়ে গেছি।
বরং তাঁর সঙ্গে সব থেকে বেশি আলাপ জমতো উপন্যাস ও চলচ্চিত্র নিয়ে। উপন্যাসের ক্ষেত্রে পঞ্চাশের দশকের পাঁচ বন্দ্যেপধ্যায় যেমন তাঁর প্রিয় ছিলো তেমনি তাঁর প্রিয় ছিলো গজেন্দ্র কুমার মিত্র, প্রবোধ সান্যাল, প্রমথ নাথ বিশী, হরিনারায়ন রায়, সতীনাথ ভাদুড়ি প্রমুখ।
তবে বঙ্কিম থেকে শুরু করে একেবারে ২০২৩ সালের ঈদ সংখ্যার উপন্যাসও তিনি যে কত মনোযোগ দিয়ে পড়তেন তা সত্যিই এক অবিশ্বাস্য বিষয়। আর এ সব উপন্যাসের বিভিণ্ণ লাইন, বিভিন্ন পরিচ্ছদের অংশ তাঁর এমনভাবে মুখস্ত থাকতো যে অনেক সময় তাঁর প্রশ্নে বিব্রত হতে হতো।
আর শুধু রাজনীতিক নয়, নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী ও সমাজ সংস্কারে বিশ্বাসী মানুষ হিসেবে তিনি ঠিক জায়গাটিই চিহ্নিত করতেন যে কোন উপন্যাসের। জীবনে কতবার তিনি অন্তত আমার সঙ্গে বঙ্কিমের দুর্গেশনন্দিনীর ওই অংশ বলেছেন, “… পরিস্কার স্বরে আয়েশা কহিলেন, “ ওসমান যদি তুমি জিজ্ঞাসা করো, তবে আমার উত্তর এই যে, এই বন্দী আমার প্রানেশ্বর!” মতিয়া চৌধুরি বলতেন, শরৎচন্দ্র বলো আর রবীন্দ্রনাথ বলো এমনকি আধুনিক যুগে এসেও কোন উপন্যাসিক বঙ্কিমের মতো এমন সাহসী উচ্চারণ করেনি। আর কোন উপন্যাসিক এমনি ভাবে কোন আয়েশার মুখ দিয়ে জগতসিংহকে তার প্রানেশ্বর বলার সাহস পায়নি। কেউ এই বেড়া ভাঙ্গতে পারেনি।
আবার গজেন্দ্র কুমার মিত্রের কলকাতার কাছে, বা উপকন্ঠেতে নারীর শরীর কত শস্তা এ সমাজে, অভাব কত নির্মম এগুলো তার প্রান ছুঁয়ে যেতো বলেই হয়তো- বার বার এ নিয়ে আলাপ করতেন।
আর চলচ্চিত্রের কাহিনীকারদের মধ্যে তার অনেক বেশি দুর্বলতা ছিলো খাজ্জা আহমদ আব্বাস ও সাদাত হাসান মান্টোর কাহিনী বা গল্পের প্রতি। সাদাত হাসান মান্টো এখনও আমাদের দেশে বহুল পঠিত হলেও খাজা আহমদ আব্বাস অনেক খানি বিস্মিৃতির অতলে চলে গেছেন। অথচ মতিয়া চৌধুরি বার তার উপন্যাস নির্ভর চলচ্চিত্রের সেই অসহনীয় দৃশ্যটি মনে করতেন বার বার, ক্ষুধার জ্বালায় পা দিয়ে ডলা দিয়ে ধান থেকে চাল বের করছে।
দেশভাগ ও ক্ষুধা এ দুটো মান্টো ও খাজা আহমদ আব্বাস শিল্পের এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন যা অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। আর এগুলো হৃদয়ে গাঁথা ছিলো মতিয়া চৌধুরির।
জীবনের শেষের দিকে এসে ব্যবসায়ীদের রাজনৈতিক উত্থান ও দুর্নীতি দেখে তিনি অনেক বেশি হতাশ ছিলেন। সে হতাশা সাংবাদিক বলে হয়তো তিনি আমাদের সঙ্গে প্রকাশ করতেন না। কমিউনিস্ট পার্টির নিয়মের কারণে হোক আর নিজের দলের শৃঙ্খলার কারণে হোক- এ সব বিষয়ে তিনি চুপ থাকতেন। বা কেন চুপ থাকতেন তা জানার উপায় আজ আর নেই। তবে একদিন এই দুর্নীতির প্রসঙ্গ আসতেই তিনি বলেছিলেন, “ দেখ বজলুকে বিয়ে করার আগে তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম যে শর্ত ছিলো তা হলো, আমরা কোন সন্তান নেব না। বজলু আমার মুখের দিকে তাকাতেই আমি তাকে বলেছিলাম, সন্তান স্নেহ ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী সকলকে অন্ধ করেছিলো, আমিও সন্তান নিলে তার স্নেহে অন্ধ হবো। আর তার জন্যেই হয়তো আমি দুর্নীতি করবো। তুমিতো জানো সততা ছাড়া রাজনীতি কখনই রাজনীতি নয়। আর একদিন বিপ্লবী হিসেবে ফাঁসির দড়িকে মেনে নেয়ার থেকে প্রতিদিন সৎ থাকা সহস্রগুন কঠিন কাজ।“ তারপর একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, “ আমি আমার রাজনীতির জন্যে বজলুকে ঠকিয়েছি আর সে উত্তীয়’র মতো তাঁর জীবন আমার জন্যে দিয়ে গেছে”।
মতিয়া চৌধুরি বাংলাদেশের প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিলেন। ২০১০ বা কোন এক সময়ে ছাত্র ই্উনিয়নের একটা কোন দিবস পালনে শহীদ মিনারে অনুষ্ঠান ছিলো। কী কারণে যে ওই অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম তা এখন আর মনে নেই। তবে সেদিনের মতিয়া চৌধুরির ভাষণটি বার বার মনে প্রশ্ন আনে, তিনি বলেছিলেন, “ আমরা তো একটা বটবৃক্ষ রেখে গিয়েছিলাম, সেটা বনসাই হয়ে গেলো কী করে”!
বাস্তবে ছাত্র ইউনিয়ন শুধু রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন ছিলো না। তারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী হলেও খেলাঘর, উদিচী, আর তাদের অনেক রাজনৈতিক কর্মকান্ড মিলে আধুনিক যে বাঙালি সংস্কৃতির একটা ঝলক এই পূর্ববাংলার আকাশে দেখা গিয়েছিলো সেখানে তাদের অনেক অবদান আছে।
তবে মতিয়া চৌধুরি হয়তো শুধু সেদিন ছাত্র ইউনিয়নকে বনসাই দেখেছিলেন, তিনি কেন যে দেখতে পাননি বাঙালি সংস্কৃতির সেই গাছটি বনসাই হয়ে যাচ্ছে তাদের হাত ধরে- তা এক বড় বিষ্ময়।
অনেকে বলেন, মতিয়া চৌধুরির মতো নেতারা বাম প্রগতিশীল আন্দোলন ফেলে আওয়ামীলীগে যোগ দিয়েছিলেন বলেই হয়তো এই বনসাই অবস্থা। তবে মতিয়া চৌধুরি আওয়ামী লীগের কোন সুদিনে আওয়ামী লীগে যোগ দেননি। ১৯৭৫ এর পরে আওয়ামী লীগের দুর্দিনেই তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। আওয়ামী লীগের সে সময়ের জেনারেল সেক্রেটারি আব্দুর রাজ্জাক তার বাসায় গিয়েও তাকে আওয়ামী লীগে যোগ দিতে নিষেধ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “ চৌধুরি তুমি এখানে এলে কিছুই করতে পারবে না” । বজলু ভাই এর ও যে খুব মত ছিলো তাও নয় বলে বলতেন মতিয়া চৌধুরি।
তারপরেও তিনি আওয়ামী লীগের মতো একটি মাল্টিক্লাস পার্টিতে এসেও তাঁর সততা বজায় রেখেছিলেনজীবনের শেষ দিন অবধি। যখন শুধু এমপি ছিলেন তখন তিনি সাধারণ লাইন বাসে নিজ নির্বাচনী এলাকায় যেতেন। কখনও তিনি এমপিদের শুল্কমুক্ত ওই কোটি টাকা দামের গাড়ি নেননি। আর সে অর্থও তার ছিলো না।
ঢাকা উত্তরের সাবেক মেয়র আনিসুল হক এর সঙ্গে সম্পর্কটা ছিলো আশির দশক থেকে। তখন তিনি ব্যবসায়ী নন, বরং টেলিভিশনের একজন জনপ্রিয় অনুষ্ঠান উপস্থাপক। এই সাংস্কৃতিক যোগাযোগটাই তার মৃত্যু অবধি বন্ধুত্বও হিসেবেই ছিলো।
আনিসুল হককে যেমন আমি ভাই ডাকতাম তিনি তেমনি আমাকে দাদা ডাকতেন। তার ভরাট গলায় একদিন দুপুরে আমাকে ফোন করে বলেন, “ দাদা ঘন্টা দুয়েক সময় দিতে পারবে আমাকে”। ওই মুহূর্তে হাতে কিছু কাজ থাকলেও বন্ধুত্বের ডাকে সাড়া দিতে হয়। তার কথা মতো অফিসার্স ক্লাবে আসার পরে তিনি বলেন, তার সঙ্গে একটু মতিয়া চৌধুরির বাসায় যেতে হবে। তিনি কখনও যাননি। এবং বলেন, দেখ ব্যবসায়ী হিসেবে যাচ্ছি না। ব্যবসায়ী হিসেবে গেলে আমি অন্য কাউকে নিয়ে যেতে পারতাম।
মতিয়া চৌধুরিকে ফোন করে জানতে পারি তিনি ঘন্টা খানেকের জন্যে বাসায় আছেন। অফিসার্স ক্লাব থেকে পাঁচ মিনিটের পথও নয় তাঁর বাসা। আমি আমার ছোট টয়োটা গাড়িতেই যাই। আমি জানতাম না আনিস ভাই তার বিশাল গাড়িতে মতিয়া চৌধুরির জন্যে এত মিষ্টি, ফলমূল ও অনান্য জিনিস এনেছেন।
মতিয়া চৌধুরির ৬’শ বর্গফুটের বাসায় দুটো কাঠের চেয়ার আর একটা সোফা, ফ্রিজ ও জানালার ধারে একটা ডাইনিং টেবিল থাকার পরে সত্যি অর্থে আনিস ভাই এর ওই পরিমান মিষ্টি, ফলমূল এসব রাখার জায়গা ছিলো না। মতিয়া চৌধুরি শুধু সেগুলোর দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, “ আমি তো একা মানুষ” । আনিস ভাইয়ের মুখ লজ্জায় লাল হয়ে যায়। তারপরে মনে হয় মিনিট পাঁচেক সেখানে থাকেন। ও সামান্য কুশল বিনিময় করেই বের হন।
ওনার বাসা থেকে বের হতেই বুঝতে পারি, আনিস ভাই কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে। শুধু আমার হাত ধরে বলেন, আমার হাতে এখনও এক ঘণ্টা সময় আছে কিনা? মাথা নাড়তেই তিনি হাত ধরে তার গাড়িতে তোলেন।
ড্রাইভার জিজ্ঞেস করে, কোথায় যাবো, তিনি বলেন, এই এলাকায় ঘুরতে থাকো। প্রায় পনের মিনিট নিশ্চুপ থাকার পরে আনিসভাই আমার হাত ধরে বলেছিলেন, “ দাদা, বাংলাদেশে কোন রাজনৈতিক দলে এমন পাঁচ জন সৎ নেতা থাকলে ওই দলকে জনগনই পঞ্চাশ বছর ক্ষমতায় রেখে দিতো”।
মতিয়া চৌধুরির ওই সততা ও তাঁর রাজনৈতিক জীবন নিয়ে সম্ভবত দুই হাজার ২০০৬ বা ২০০৭ এর দিকে একদিন কথা হচ্ছিলো ঐতিহাসিক তপন রায় চৌধুরির সঙ্গে। তিনি কিছুটা শুনেই বলেন, স্বদেশ তুমি ওনার জীবন ভিত্তিক একটা ইতিহাস কেন লেখ না। হেসে বলেছিলেম, দাদা আমরা জীবিকার দায়ে দু’ কলম লেখার সাংবাদিক মাত্র। ইতিহাস লেখার মতো সময় আমাদেরকে কে ধার দেবে? পৃথিবী সবাইকে সব কিছু দেয় না। তপনদা তারপরেও ধমক দিয়েছিলেন। তার ধমকের উত্তরে বলতে পারেনি, যদি কোন প্রজম্ম কখনও শান্ত ও স্বাভাবিক পরিবেশ পায় তাহলে হয়তো তারা লিখবে। আর আপনার মতো যদি কেউ উন্নত দেশে বসে লিখতে পারে সে লিখবে। তৃতীয় বিশ্বে ইতিহাস লেখার চিন্তা না করাই ভালো। আর ইতিহাস সহস্র বছর পরেও খাঁটি সোনার মতোই উজ্জল থাকে।
লেখক: রাষ্টীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present World.