০৮:৪২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৫

ব্রিটিশ রাজত্বে সুন্দরবন (পর্ব-৫৮)

  • Sarakhon Report
  • ১২:০০:১৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৪
  • 29
শশাঙ্ক মণ্ডল
 লবণ

তৃতীয় অধ্যায়

১৮৪৯ খ্রীষ্টাব্দে লবণ উৎপাদন বন্ধ করার প্রস্তাব শুনে বাগুন্ডীর সল্ট সুপার বিরোধিতা করে সরকারকে একটি রিপোর্ট করেন-তাতে তিনি কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রেখেছিলেন তা এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে-

ক) এই শিল্প বন্ধ হলে অনেক লোক কর্মহীন হয়ে পড়বে। কারণ গ্রামীণ শ্রমিকদের বছরের একটা বড় অংশে কোন কাজ থাকে না। সে সময় সারা বাংলাদেশের প্রায় ৬০ হাজার মানুষ এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত থাকে শ্রমিক, গাড়োয়ান, বোট মাঝি, কায়াল, ব্যাপারী সব মিলিয়ে।

খ) কৃষিজাত ফসলের দাম খুবই কম। টাকা পয়সার অভাবে বাজারে কেনা বেচা খুব বেশি হয় না। দাদনের টাকা মালঙ্গীদের হাতে এলে অভ্যন্তরীণ বাজার একটু চাঙ্গা হয়ে ওঠে।

গ) জমিদাররা বিপদে পড়বে। খাজনা আদায় করতে পারবে না- চাষিরা লবণের জন্য দাদনের টাকা হাতে পেলে সেই টাকা থেকে জমিদারদের খাজনা শোধ করে দেয়।

ঘ) দারিদ্র অপরাধের জন্ম দেয়-গরিব মানুষগুলির অভাব বেড়ে গেলে দেশের অভ্যন্তরে স্থিতি নষ্ট হয়ে যাবে। পূর্বের মতো চুরি, ডাকাতি রাহাজানি বেড়ে যাবে।

উনিশ শতকের ১ম ভাগ পর্যন্ত সুন্দরবনের গরিব মানুষ এই শিল্পের মাধ্যমে অসময়ে কাজের সুযোগ পেত। আরও কিছু মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্যর মধ্য দিয়ে উদ্বৃত্ত সম্পদ কিছুটা অর্জন করত। লবণ শিল্প অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কিছুটা গতিবেগ সৃষ্টি করেছিল। অবশ্য মনে রাখতে হবে এই শিল্পকে কেন্দ্র করে চাষযোগ্য জমি প্লাবিত করা হয়েছে-শ্রমিকের মজুরির ব্যাপারে অনেক সময় চরম বঞ্চনা সহ্য করতে হয়েছে মাহিন্দার মালঙ্গীদের; সমকালে পৃথিবীর বিভিন্ন লবণ উৎপাদনের উন্নত প্রথা গ্রহণ না করে সাবেকি উৎপাদনপদ্ধতির মধ্য দিয়ে কোম্পানীর কাছে লাভটাই ছিল প্রধান।

অগ্রিম দাদনের টাকা এই শিল্পে পুরোটা নিয়োজিত না করে ইজারাদাররা জমিদারিতে অর্থ বিনিয়োগ করেছে, লবণ আইন কার্যকরী করার মধ্য দিয়ে গ্রামের অসহায় কৃষক নানা ধরনের জুলুমের শিকার হয়েছে কিন্তু তা সত্ত্বেও ব্রিটিশ রাজত্বে একফসলি নোনা মাটির দেশ সুন্দরবনে এই শিল্প ধ্বংসের মধ্য দিয়ে গ্রামীণ জীবনে দরিদ্র কৃষি শ্রমিকদের সংখ্যা তীব্রভাবে বেড়ে গিয়েছিল তা আমাদের এই এলাকার বিভিন্ন জেলা গেজেটিয়ারগুলিতে উনিশ শতকের শেষে লক্ষ করা গেল। বিকল্প কাজের সুযোগ ফধ্বংস হয়ে গেল এই শিল্পের অপমৃত্যুর ফলে, কৃষির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ল প্রায় সমস্ত মানুষ এবং তাদের উপর শুরু হল জঘন্যতম সামন্ততান্ত্রিক অত্যাচার। তারই ইতিহাস সুন্দরনের কৃষকের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।

জনপ্রিয় সংবাদ

ব্রিটিশ রাজত্বে সুন্দরবন (পর্ব-৫৮)

১২:০০:১৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৪
শশাঙ্ক মণ্ডল
 লবণ

তৃতীয় অধ্যায়

১৮৪৯ খ্রীষ্টাব্দে লবণ উৎপাদন বন্ধ করার প্রস্তাব শুনে বাগুন্ডীর সল্ট সুপার বিরোধিতা করে সরকারকে একটি রিপোর্ট করেন-তাতে তিনি কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রেখেছিলেন তা এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে-

ক) এই শিল্প বন্ধ হলে অনেক লোক কর্মহীন হয়ে পড়বে। কারণ গ্রামীণ শ্রমিকদের বছরের একটা বড় অংশে কোন কাজ থাকে না। সে সময় সারা বাংলাদেশের প্রায় ৬০ হাজার মানুষ এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত থাকে শ্রমিক, গাড়োয়ান, বোট মাঝি, কায়াল, ব্যাপারী সব মিলিয়ে।

খ) কৃষিজাত ফসলের দাম খুবই কম। টাকা পয়সার অভাবে বাজারে কেনা বেচা খুব বেশি হয় না। দাদনের টাকা মালঙ্গীদের হাতে এলে অভ্যন্তরীণ বাজার একটু চাঙ্গা হয়ে ওঠে।

গ) জমিদাররা বিপদে পড়বে। খাজনা আদায় করতে পারবে না- চাষিরা লবণের জন্য দাদনের টাকা হাতে পেলে সেই টাকা থেকে জমিদারদের খাজনা শোধ করে দেয়।

ঘ) দারিদ্র অপরাধের জন্ম দেয়-গরিব মানুষগুলির অভাব বেড়ে গেলে দেশের অভ্যন্তরে স্থিতি নষ্ট হয়ে যাবে। পূর্বের মতো চুরি, ডাকাতি রাহাজানি বেড়ে যাবে।

উনিশ শতকের ১ম ভাগ পর্যন্ত সুন্দরবনের গরিব মানুষ এই শিল্পের মাধ্যমে অসময়ে কাজের সুযোগ পেত। আরও কিছু মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্যর মধ্য দিয়ে উদ্বৃত্ত সম্পদ কিছুটা অর্জন করত। লবণ শিল্প অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কিছুটা গতিবেগ সৃষ্টি করেছিল। অবশ্য মনে রাখতে হবে এই শিল্পকে কেন্দ্র করে চাষযোগ্য জমি প্লাবিত করা হয়েছে-শ্রমিকের মজুরির ব্যাপারে অনেক সময় চরম বঞ্চনা সহ্য করতে হয়েছে মাহিন্দার মালঙ্গীদের; সমকালে পৃথিবীর বিভিন্ন লবণ উৎপাদনের উন্নত প্রথা গ্রহণ না করে সাবেকি উৎপাদনপদ্ধতির মধ্য দিয়ে কোম্পানীর কাছে লাভটাই ছিল প্রধান।

অগ্রিম দাদনের টাকা এই শিল্পে পুরোটা নিয়োজিত না করে ইজারাদাররা জমিদারিতে অর্থ বিনিয়োগ করেছে, লবণ আইন কার্যকরী করার মধ্য দিয়ে গ্রামের অসহায় কৃষক নানা ধরনের জুলুমের শিকার হয়েছে কিন্তু তা সত্ত্বেও ব্রিটিশ রাজত্বে একফসলি নোনা মাটির দেশ সুন্দরবনে এই শিল্প ধ্বংসের মধ্য দিয়ে গ্রামীণ জীবনে দরিদ্র কৃষি শ্রমিকদের সংখ্যা তীব্রভাবে বেড়ে গিয়েছিল তা আমাদের এই এলাকার বিভিন্ন জেলা গেজেটিয়ারগুলিতে উনিশ শতকের শেষে লক্ষ করা গেল। বিকল্প কাজের সুযোগ ফধ্বংস হয়ে গেল এই শিল্পের অপমৃত্যুর ফলে, কৃষির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ল প্রায় সমস্ত মানুষ এবং তাদের উপর শুরু হল জঘন্যতম সামন্ততান্ত্রিক অত্যাচার। তারই ইতিহাস সুন্দরনের কৃষকের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।