আবু ইসহাক
সরকারি কর্মজীবীর সংসারে সবচেয়ে তাড়াহুড়োর সময় হচ্ছে ভোরবেলাটা। এ সময়ে গৃহকর্তা ব্যস্ত থাকেন গোসলখানায় আর গৃহকর্ত্রী রান্নাঘরে। ইলিয়াস একজন সরকারি কর্মজীবী। সুতরাং তাঁর সংসারেও এর ব্যতিক্রম হওয়ার কোনো কারণ নেই।
অনেক দিন আগের এক সকালবেলা। দাড়ি চাঁচার জন্য থুতনি ও দু’গালে সাবান মেখে নিরাপদ ক্ষুর হাতে নিয়েছেন ইলিয়াস, এমন সময় গিন্নির গলার আওয়াজ পেয়ে তিনি কান খাড়া করলেন। গলার স্বর সপ্তমে চড়িয়ে তিনি বলছেন, এগুলো কী কিনেছে। এ কেমনতরো ঘি। ছি-ছি-ছি, ময়দাগুলোই নষ্ট হয়ে গেল। ইস, কী দুর্গন্ধ! সাবানের ফেনায় ইলিয়াসের মুখটা তখন সার্কাসের রঙ্গরসিক তামাশাবাজ সঙের
চেয়েও বদসুরত ও হাস্যোদ্দীপক। এ অবস্থায় তিনি গোসলখানা থেকে বেরুবেন কি না ভাবছেন, এমন সময় আধ-খোলা দরজায় করাঘাত-খট-ঘট-খট।
দরজাটা টান দিয়ে পুরো খুলতেই ইলিয়াস দেখেন, উগ্রমূর্তি গিন্নি। তাঁর হাতে একতাল ময়দা।
-এগুলো কী কিনেছ? এগুলো কি ঘি?
কী হয়েছে? এত চেঁচাচ্ছ কেন? –
-এগুলো কি ঘি? দ্যাখো, শুঁকে দ্যাখো।
গিন্নি ময়দার তালটা তাঁর নাকের ডগার কাছে ধরে বললেন, দ্যাখো, কী দুর্গন্ধ! সত্যি দুর্গন্ধ। নাকটা সরিয়ে নিয়ে ইলিয়াস বললেন, এতো কেমন পোড়া মবিলের
গন্ধ! হায়, হায়, হায়! মাতারি দুটো এভাবে ঠকিয়ে গেল!
-এগুলো এখন কী করব?
-ফেলে দাও। আজ আর পরোটার দরকার নেই। সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে সাদা রুটি বানিয়ে ফেলো কয়েকটা।
দাড়ি চেঁচে গোসল করে ইলিয়াস রান্না ঘরে ঢুকলেন। তাক থেকে ঘি-এর পাত্রটা নামিয়ে ঢাকনা খুলতেই সেই দুর্গন্ধ পেলেন। তামাটে তরল পদার্থ দেখেই বুঝলেন, এগুলো পোড়া মবিল ছাড়া কিছু নয়।
গিন্নি ঝাঁজালো কন্ঠে বললেন, কেনার আগে গন্ধ শুঁকে দ্যাখো নি?
-দেখেছিলাম তো! জলজ্যান্ত ঘি-এর গন্ধ শুঁকেই তো কিনেছিলাম। এতটা ঘি মবিল হয়ে গেল কেমন করে? মাইনের হালাল রুজির নগদ টাকায় ঘি কিনেছি। ঋণং কৃত্বা ঘৃতং হলেও বুঝতাম ঋণ করে ঘি কিনেছি বলে তা মবিল হয়ে গেছে।
চোর-ডাকাত আর ঠগবাজ ধরার কাজ তোমার। আর তোমাকেই ঠকিয়ে গেল। তাও আবার দুই মাতারি।
এ টিটকারি নীরবে হজম করা ছাড়া উপায় নেই। চোর-ডাকাত, ঠগবাজ-ধোঁকাবাজ ইত্যাদি অপরাধী নিয়েই তো ইলিয়াসের কারবার। শুধু তা-ই নয়, কুমিল্লা কারিফকড় থেকে শুরু করে বিহারের শতনামী চামার পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গার শ’ দেড়েক বাটপাড় দাগাবাজ অপরাধী-সম্প্রদায় এবং তাদের অপরাধের ফন্দি-ফিকির, কায়দা-কৌশল সম্বন্ধে তিনি পড়াশোনা করেছেন, বিভাগীয় পরীক্ষায় অপরাধবিজ্ঞানে প্রথম হয়েছেন। আর তাঁকেই কিনা ঠকিয়ে গেল দুটো মেয়েলোক!
১৯৫৬ সালের কথা। ইলিয়াসের বয়স তখন তিরিশের কাছাকাছি। ঢাকা থেকে বদলি হয়ে করাচী গিয়েছিলেন। বাসা পেয়েছিলেন পুরানা লালুখেতে। বাসায় ওঠার মাসখানেক পরের একদিন। সরকারি কাজে বাইরে ঘোরাঘুরি করে তিনি দুপুরবেলা বাসায় ফিরেছেন। খেতে বসবেন, ঠিক এমন সময় পেছনের দরজায় খট-খট আওয়াজ হলো। গিয়ে দরজা খুলতেই দেখেন, দু’জন মেয়েলোক। একজন ময়লা সালোয়ার- কামিজ-ওড়না পরিহিতা বিপুলদেহী প্রৌঢ়া। তার মাথায় দাড়ি-পাল্লা ও বাটখারা। অন্যজন পরিচ্ছন্ন সালোয়ার-কামিজ-ওড়না পরিহিতা তন্বী যুবতী। তার মাথায় পেতলের কলসি।
-ঘি রাখবে? উর্দুতে জিজ্ঞেস করলে প্রৌঢ়া।
ইলিয়াস মনে করলেন, এরা গাঁয়ের গোয়ালিনি। এদের কাছে খাঁটি জিনিস পাওয়া যাবে। তিনি উর্দুতে বললেন, দেখি কী রকম ঘি?
যুবতীটি তার মাথা থেকে কলসি নামিয়ে নিচে রাখল।
সিধে আঙুলে নাকি ঘি ওঠে না। কিন্তু গন্ধ শুঁকবার জন্য সিধে আঙুলই যথেষ্ট। সিধে তর্জনীর মাথা ঘিয়ে ডুবিয়ে বুড়ো আঙুল দিয়ে ঘষে তিনি গন্ধ শুঁকে দেখলেন। চমৎকার গন্ধ। ঘি ভালো তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
-কত করে সের? জিজ্ঞেস করলেন ইলিয়াস।
-ছ’টাকা। প্রৌঢ়া উত্তর দিল।
করাচীতে সিল-করা টিনের খালেস অর্থাৎ খাঁটি ঘি-এর দাম তখন সাড়ে ছ’ টাকা।
সুতরাং দরাদরি না করে ইলিয়াস পাত্র এনে বললেন, একসের দাও।
ঘি-এর পাত্রটা তাঁদের একটু বড়ই। সের পাঁচেক ঘি ধরে ওটায়। খালি পাত্রটার
ওজন নিয়ে প্রৌঢ়া তাদের কলসি থেকে ঘি ঢালতে লাগল। পাত্রটার কানা পর্যন্ত ভরে বলল,-নাও পাঁচ সের দিচ্ছি।
মাসের শেষে মাইনের টাকাও প্রায় শেষ। তাই তিনি তাড়াতাড়ি বললেন,-না-না, তুমি একসের দাও। বলা বাহুল্য, উর্দুতেই চলছে তাদের কথাবার্তা।
প্রৌঢ়া তাঁর পাত্র থেকে কিছুটা ঘি তার কলসিতে ঢেলে নিয়ে বলল, নাও, তিন সের দিচ্ছি। এমন ভালো ঘি আর পাবে না।
-না, না, তুমি একসের দাও।
পাত্র থেকে আবার কিছুটা ঘি তার কলসিতে ফেরত নিয়ে বলল, দু’সের তো নেবে? দু’সের দিচ্ছি।
-না, না, আমি একসেরের বেশি নেরই না। বারবার বলছি, শুনছ না?
অগত্যা আরো কিছুটা ঘি তার কলসিতে ফেরত নিয়ে ইলিয়াসকে একসের মেপে দিয়ে সে বলল, যে ঘি দিয়ে গেলাম তা খেয়ে আবার আমাকে ইয়াদ করবে।
তারপর একসেরের দাম ছ’টাকা নিয়ে তারা চলে গেল।
গিন্নি আবার ঝাঁজিয়ে উঠলেন, ঠগের হাতে ঠকে ঠোক্কর খেয়ে একেবারে থ’ মেরে গেলে যে! মেয়েলোকের হাতে ঠকে যায় যে পুরুষ, সে আবার ঠগবাজ!
গিন্নির টিটকারি কোনোরকমে হজম করে ইলিয়াস ভাবতে লাগলেন, কাণ্ডটা কী ঘটে গেল! ঘি কেমন পোড়া মবিল হয়ে গেল? ব্যাপারটা বুঝতে তাঁর দেরি হলো না বেশিক্ষণ। ঘি মবিলের চেয়ে হালকা।
কলসিভরা পোড়া মবিলের উপর ভেসে ছিল সামান্য কিছু খাঁটি ঘি। সেই ঘি-এর গন্ধ শুঁকেই তিনি ঘি কিনেছিলেন। কলসি থেকে ঢালার সময় ভাসমান ঘি তাঁর পাত্রে পড়ে গিয়েছিল। তিন-তিন বার তাঁর পাত্র থেকে ঢেলে সেই ঘি টুকু ওরা ওদের কলসিতে ফেরত নিয়ে নিয়েছিল আর তাঁর পাত্রে রেখে গিয়েছিল এ অখাদ্য বস্তু-পোড়া মবিল। ঠগ মেয়েলোক দুটিকে আর কোনো দিন দেখা যায় নি। প্রৌঢ়া মেয়েলোকটি বলেছিল, তার ঘি খেয়ে আবার তাকে ইয়াদ করতে হবে। তার ঘি না খেয়েই ইলিয়াসকে সারা জীবন তার কথা ইয়াদ করতে হবে।