হানিফ মোল্লা
তাহার সুকণ্ঠের গান আকাশ-বাতাস ছাড়াইয়া আমার সেই বালকমনকে কোন সুদুরে লইয়া যাইত। এইভাবে ৭/৮ দিন গাবপানি দিয়া নৌকা পানিতে নামানো হইত। তারপর আমার পিতাকে দিয়া নৌকার চালান লেখাইয়া সেই কাগজের উপর ভাগীদের টিপসই লওয়া হইত। একটি শুভদিনে ভাগীদের সঙ্গে লইয়া বচন মোল্লা নৌকায় উঠিতেন। বচন মোল্লার মা, কেদারীর মা, মুন্দিরার মা আর জুলমতের মা নৌকার গলুইতে পান-সুপারি দিয়া সালাম করিত। আর বলিত, “নৌকা। আমাদের ছেলেদের ছহি ছালামতে দেশে ফিরাইয়া আনিও।” গ্রামের ছেলে-বুড়ো যুবক-যুবতী সকলেই নদীতীরে আসিয়া দাঁড়াইত। যতক্ষণ নৌকার পালের শেষ রেখাটি দেখা যাইত ততক্ষণ বচন মোল্লার মা, জুলমতের মা, মুন্দিরার মা আর কেদারীর মা নদীতীরে দাঁড়াইয়া থাকিত।
তারপর চোখের পানি মুছিতে মুছিতে ঘরে ফিরিয়া যাইত। মুন্দিরার মায়ের সঙ্গে কেদারীর মার ভালো ভাব ছিল না। এটা-ওটা লইয়া প্রায়ই তাহাদের মধ্যে দারুণ কলহের উদয় হইত। কিন্তু আজ কেদারীর মা মুন্দিরার মার পরম বন্ধু। দুইজনের ছেলেই বিদেশে বাণিজ্য করিতে গিয়াছে। ঘাটে বসিয়া দুই বিধবা নদীর দিকে চায় আর নিজ নিজ ছেলের বিষয়ে আলোচনা করে। পনেরো-ষোলদিন পরে নদীর তীর আবার লোকজনে ভর্তি হইয়া যায়। যাহাদের ছেলেরা বাণিজ্যে গিয়াছে তাহারা বারবার নদীর তীরে আসিয়া দূরের নৌকাগুলির দিকে চাহিয়া থাকে। ভাগীদার আর বেপারীর বউরা শাশুড়িদের মতো নদীতীরে আসিয়া প্রকাশ্যে আহা-উহু করিতে পারে না। নানা অছিলায় নদীতে পানি আনিতে আসিয়া ঘোমটার ফাঁক দিয়া দূরের নৌকাগুলি নিরীক্ষণ করিতে থাকে। যেদিন ঝড়তুফান হয় সেদিন তাহাদের বাড়িতে হাহাকার পড়িয়া যায়। আল্লার নামে কতরকম মানত করিতে থাকে।
তারপর সত্য সত্য যেদিন সুদূর মালদা জেলা হইতে বচন মোল্লা তাঁর নাও-ভর্তি আম লইয়া নদীর ঘাটে নোঙর গাড়ে, সেদিন সমস্ত গ্রাম উৎসবমুখর হইয়া পড়ে। আজ বচন মোল্লা যেন কোন অসাধ্য সাধন করিয়া দেশে ফিরিয়াছে। সকলেই উৎসুকভাবে ভাগীদারদের পিছে পিছে ঘোরে, এবারের সফরের নতুন নতুন কাহিনী শুনিতে, কিন্তু আম না বেচিয়া কাহারও মুহূর্তের অবসর নাই। পাঁচ-ছয় দিনে আম বেচা শেষ হইলে গ্রামের সব লোক কাজেম ফকিরকে ঘিরিয়া বসে, এবারের সফরের নতুন কাহিনী শুনিতে। কাজেম ফকিরও এতদিন অপেক্ষা করিতেছিল এই দিনটির জন্য। এবারের সফরে তার মনে যে কাহিনী সঞ্চিত হইয়াছে তাহা প্রকাশ করিতে না পারিলে কাজেমের নিজেরই মনে সোয়াস্তি ছিল না। কিছুটা সত্য, কিছুটা কল্পনা মিশাইয়া কাজেম তাহার নতুন গল্প আরম্ভ করে। সে যখন হয়রান হইয়া পড়ে তখন রহিম মল্লিকের গান।
সেই আমাদের মরা গাঙ দিয়া অনেক দূর যাইয়া তাহাদের নৌকা যখন পদ্মার গাঙে পড়িত, তখন পদ্মার ঢেউ দেখিয়া মাঝিরা আল্লার ফানি করিয়া উঠিত। বচন মোল্লা হাল হইতে নামিয়া আসিয়া গাঙের পানিতে সোয়াসের চিনি ছাড়িয়া দিতেন। তারপর নৌকা ভাসিয়া যাইত গোয়ালন্দের মোকামে। সেখানে যমুনা আর পদ্মা পাশাপাশি চলিয়াছে। সেখান দিয়া একদিন নৌকা বাহিলে সামনে নিরাইলার চর। সেখানে রান্নাবাড়ি করিয়া ভাগীরা রাত্রযাপন করিত। পরদিন পাবনা জেলা বামে ফেলিয়া গোড়াই নদীর ওপারে চিরিঙ্গি বাজার। সামনে গোদাগাড়ির বন্দর। তার পশ্চিমে নেতা-ধুপুনীর ঘাট। এখানে নেতা-ধূপুনীর সঙ্গে বেহুলার দেখা হইয়াছিল। এই ঘাট ছাড়িয়া নিকাড়ি বন্দর পার হইলেই ইংরেজ বাজার। সুমাই নদী দিয়া আরও একদিন গেলে কাজল কোঠার গ্রাম। সেখানে নৌকা বাঁধিতেই কয়ালদারেরা আসিয়া বচন মোল্লাকে সালাম জানাইত। পরদিন তাহারা বচন মোল্লাকে সঙ্গে করিয়া আমের বাগানগুলি দেখাইত। এই সুদূরবিস্তৃত নৌকাপথখানি আজও আমার চোখে ভাসিয়া ওঠে।
ইহা ছাড়া প্রথম জোয়ারের পানি আসিলে ছোট গাঙের এপারে-ওপারে বানা বা বাঁধাল দিয়া গ্রামের লোকেরা মাছ ধরিত। বাঁধের দুইতীরের পানিতে বাঁশের চিকন সলা গাড়িয়া দেওয়া হইত। তাহারই পাশে জুতি হাতে লইয়া দুই তীরের দুই বাঁশের মাচার উপর দুইজন বসিয়া থাকিত। বানার পথ বাহিয়া বড় বড় মাছ যখন এই বাঁশের সলার মধ্যে প্রবেশ করিত তখন বাঁশের সলা নড়িয়া উঠিত। অমনি জুতি দিয়া কোপাইয়া মাছটিকে উপরে উঠানো হইত। এই কাজে হানিফ মোল্লা সবচাইতে ওস্তাদ ছিলেন। যেদিন বেশি মাছ মারা পড়িত সেদিন তাহার কিছুটা অংশ আমাদের বাড়িতে পাঠাইয়া দিতেন। কিন্তু তার জন্য আমার বিশেষ আগ্রহ ছিল না।
চলবে…