কৃষি ও কৃষক
চতুর্থ অধ্যায়
জমিদারের প্রতিনিধি নায়েব ম্যানেজাররা সেদিন সমাজের মাথা হিসাবে পরিগণিত হত। আইনশৃঙ্খলা থেকে শুরু করে সমাজশাসন সবকিছুতেই তাঁরা মাথা গলাত। তাঁদের অনুমতি ছাড়া ব্যবসা বাণিজ্য বিদেশগমন, বিবাহ করতে পারত না। ধান চালের কিংবা মাছ দুধের ব্যবসা, এলাকায় কে করবে তা এই নায়েবরা ঠিক করে দিত। গ্রামের পাটনী নদী পারাপার করাতো, সে এই নায়েব এর অনুমতিক্রমে একাজ করত; বাইরে কোন লোক লাটে এলে পাটনীর মাধ্যমে নায়েব মশাই জেনে যেত। সুন্দরবনের নদীর নোনা জল যাতে ক্ষেত প্লাবিত করতে না পারে সেজন্য সরকার থেকে নদীবাঁধের দায়িত্ব জমিদারদের ওপর ন্যস্ত করেছিল এবং এই বাঁধ দেওয়া হয়েছে কৃষকের বেগার শ্রমের মাধ্যমে। নদীর বাঁধরক্ষা থেকে শুরু করে গ্রামের রাস্তাঘাট যতটুকু হয়েছে সবকিছুই প্রজার বেগার শ্রমের মধ্যে দিয়ে।
ব্রিটিশ পূর্ব যুগের জমিদাররা দেবোত্তর সম্পত্তির সাহায্যে শিক্ষা, দাতব্য চিকিৎসা, বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজের ব্যবস্থা করত কিন্তু সুন্দরবনের জমিদাররা এসব ব্যাপারে কোন কার্যকরী ভূমিকা নেয়নি। মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক প্রথার বীভৎসতা দিয়ে সুন্দরবনকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। স্বাধীনতা পূর্ব যুগে কালীনাথ মুন্সীরা ব্যতিক্রমই বটে। দু-একজন জমিদার কলকাতা মহানগরীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে কিন্তু সুন্দরবনে তার চাষীদের শিক্ষা সংস্কৃতি উন্নতিতে তারা কোন ভূমিকা নেয়নি – দু পাঁচ জন স্থানীয় ছোট জমিদাররা কিছু কিছু ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছেন। ধান্যকুড়িয়ার সাউ বল্লভ গায়েন, আড়বেলিয়ার বসু, মজিলপুরের দত্ত কিংবা বারুইপুরের রায়চৌধুরী, কাকদ্বীপের দিন্দা, দুলদুলীর হালদার কিংবা রামেশ্বরপুরের ঘোষেরা এরকম আরও কিছু জমিদার।
সুন্দরবনের জমিদারী ছিল সেদিন লোভনীয় ব্যাপার। The purchase of Zamindary is a sort of speculation and looked upon as a goose giving golden eggs everyday – Cal Review, July 1846. সরকারকে দেয় জমিদারদের খাজনা বাৎসরিক ভিত্তিতে নির্ধারিত ছিল কিন্তু চাষীদের দেয় জমিদারদের খাজনার কোন ভিত্তি ছিল না কারণ জমিদাররা প্রতিনিয়ত চাষীদের কাছ থেকে বেশী বেশী করে খাজনা আদায় করত। চাষীর অধিকার কোনদিন নির্ধারিত করা হল না the rights of the raiyots had never been difined. ২৪ পরগণার সহকারী জজ মিঃ আলেকজান্ডার ফ্রেজার টাইটেলার তাই খেদের সাথে মন্তব্য করেছিলেন In short their duties for making money are innumerable.
উনিশ শতকের শুরুতে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতায় যে নতুন জমিদারদের উদ্ভব হল, তাদের মধ্যে ছিল শহুরে বেনিয়া এবং ভূতপূর্ব নবাবের কর্মচারীদের প্রাধান্য। এদের মূল লক্ষ্য ছিল বর্ধিত ভূমিরাজস্ব জোর জুলুম করে আদায় করা। ঋণভারে জর্জরিত কৃষকের সঙ্গে এদের বৈরিতা প্রথম থেকে তীব্র আকার ধারণ করে। বহির্বাণিজ্যের জগতে দেশজ সূতা ও রেশম শিল্পের লাভজনক ব্যবসার অবনতি ঘটিয়ে কোম্পানি ইলেন্ডের বস্তুশিল্পের স্বার্থে বাংলা থেকে একতরফা কাঁচামাল রপ্তানি শুরু করেছিল আঠারো শতকের শেষের দিকে। উনিশ শতকের শুরুতে ইংলন্ডের কাপড় বেশী বেশী মাত্রায় আমদানি করে এদেশীয় হস্তশিল্পীদের বাজার সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। কৃষিতে বাণিজ্যিক ফসলের প্রবর্তন ধীরে ধীরে বাড়ছিল নীলচাষের মধ্য দিয়ে। দরিদ্র কৃষক ও জীবিকাচ্যুত তাঁতিদের বিক্ষোভ তিতুমীরের বিদ্রোহের পটভূমিকা হিসাবে লক্ষ করা যায়।
Sarakhon Report 



















